৫০ জলদস্যু সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের জাহাজ, ছোট বোটে এসে ১৫ মিনিটেই দখল

২৩ নাবিকের ১১ জনই চট্টগ্রামের, শেষ যোগাযোগ সন্ধ্যায়

অস্ত্রধারী ৫০ জন জলদস্যু বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ কবির গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জোর খাটিয়ে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সন্ধ্যা ৭টার দিকে নাবিকদের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছে এসআর শিপিং কর্তৃপক্ষের। ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়েছে। বিকেল পাঁচটার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে নাবিকদের কাছে থাকা ডলারও। ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরের সোমালিয়া উপকূলে জাহাজটির যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন দিন। সেখানে পৌঁছার পর জলদস্যু দলের নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে জাহাজ ও তার নাবিকদের ভাগ্য।

চট্টগ্রামভিত্তিক কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিং কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত মধ্যস্থতাকারী কোনো মাধ্যম খুঁজে পায়নি বলে জানা গেছে। জলদস্যুদের সঙ্গেও তারা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি। জলদস্যুরাও এখন পর্যন্ত জাহাজমালিকের কাছে কোনো বার্তা পাঠায়নি। তবে আগেও যেহেতু এসআর শিপিং এই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে— সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারও তারা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আশা রাখছে। ধারণা করা হচ্ছে, সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছার পর জাহাজটির মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে জলদস্যুরা।

১৫ মিনিটেই জাহাজ দখল

মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে দিয়ে দুবাইয়ের দিকে যাওয়া কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নেয় সোমালিয়ান দস্যুরা। সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থানরত জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মাত্র ১৫ মিনিট লাগে জলদস্যুদের। জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ দুপুর দেড়টার দিকে চট্টগ্রামে এসআর শিপিংয়ের কর্মকর্তাদের জানান, জলদস্যুরা তাদের জাহাজে আক্রমণ করছে। ওই সময় চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা সেই আক্রমণ যে কোনো মূল্যে ঠেকানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু এর ১৫ মিনিট পরই ক্যাপ্টেনের একটি ইমেইল বার্তা আসে চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি জানান, জলদস্যুরা জাহাজের দখল নিয়ে ফেলেছে।

কর্মকর্তারা জানান, দুইদিন আগে রোববারই (১০ মার্চ) দুবাইয়ের দিকে যাওয়া ‘এমভি আবদুল্লাহ’র গতিপথ পরিবর্তন করে সোমালিয়ার দিকে ঘুরিয়ে নেয় জলদস্যুরা।

৭ দিন পরই দুবাই পৌঁছানোর কথা ছিল

জাহাজটি ৫৮ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। নাবিক ও ক্রুসহ জাহাজটিতে ২৩ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জাহাজটিকে ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করে জলদস্যুরা। জাহাজটি ওই সময় সোমালিয়া উপকূল থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল।

কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ আগে ‘গোল্ডেন হক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তৈরি বাল্ক কেরিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেয়। বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী এরকম মোট ২৩টি জাহাজ আছে কবির গ্রুপের বহরে।

খাবার, ডলার ও ডিজেল চাইছে জলদস্যুরা

মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে পাঠানো ভয়েস মেসেজে ছিনতাই হওয়া জাহাজে থাকা একজন নাবিক ফেসবুকে বলেন, ‘আমাদের জন্য দোয়া করিও। সোমালিয়ার জলদস্যুরা অ্যাটাক করেছে। অলরেডি আমরা অ্যারেস্টেড। আমাদের এক জায়গায় বন্দি করে রাখছে। মনে হচ্ছে নিয়ে যাবে আমাদের। ওরা বোট উঠায় ফেলছে অলরেডি।’

জানা গেছে, জলদস্যুরা জাহাজটিতে উঠেই নাবিকদের কাছ থেকে সব মোবাইল নিয়ে ফেলে। জলদস্যুরা এ সময় নাবিকদের কাছে খাবার, ডলার ও ডিজেল চায়। এর মধ্যেই লুকিয়ে রাখা একটি মোবাইল থেকে একজন নাবিক ফেসবুকে জানান, ‘আমাদের জাহাজ সোমালিয়ার দিকে যাচ্ছে। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ৬০০ নটিক্যাল মাইল যেতে তিনদিন লাগবে। সেখানে জলদস্যুদের প্রধানরা আসবে।’

২৩ নাবিকের ১১ জনই চট্টগ্রামের, সাতজন ক্যাডেট

ছিনতাইয়ের শিকার ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ২৩ নাবিকের ১১ জনই চট্টগ্রামের। তারা আনোয়ারা, চন্দনাইশ ও লোহাগাড়ার বাসিন্দা। জাহাজে অবস্থানরত নাবিকদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছাড়াও রয়েছেন বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির সাতজন সাবেক ক্যাডেট। এরা হলেন— চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এএসএম সাইদুজ্জামান, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন এবং ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান। জাহাজটিতে আরও রয়েছেন— সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ এবং ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ। এছাড়া ক্রু হিসেবে রয়েছেন— এবি আনোয়ারুল হক, আসিফুর রহমান ও সাজ্জাদ হোসেন, ওএস জয় মাহমুদ, নাজমুল হক ও আইনুল হক, অয়েলার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন ও আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশাররফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক শফিকুল ইসলাম, জিএস নূর উদ্দিন এবং ফিটার সালেহ আহমেদ।

পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আশা

রাতে কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা জেনেছি, জাহাজে থাকা ২৩ জন ক্রুকে একটি কেবিনে আটকে রেখেছে জলদস্যুরা। তবে তাদের সবাই নিরাপদে আছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও মধ্যস্থতাকারী কোনো মাধ্যম খুঁজে পাইনি। জলদস্যুদের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে যেহেতু আগেও আমাদের এই রকম অবস্থায় পড়তে হয়েছে, ফলে আমরা এবারও পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারবো আশা করছি। আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু আমরা দেখছি না।’

সর্বশেষ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাহাজে থাকা নাবিকদের সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে কেএসআরএমের এই মিডিয়া উপদেষ্টা বলেন, ‘জাহাজে জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ রেখে যাচ্ছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!