হাসপাতাল ছাড়লেও চট্টগ্রামের বিস্ফোরণে আহতদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আরেক আতঙ্ক

দরকার মানসিক কাউন্সেলিং, বলছেন বিশেষজ্ঞরা

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ সাইদুর ইসলাম। তার বাড়ি ফেনী হলেও থাকতেন সীতাকুণ্ডের কুমিরায়। ঘটনার দিন (৪ জুন) সন্ধ্যায় ওয়াইফাই সংযোগের ত্রুটি সারাতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তিনি। আগুনে তার শরীরের প্রায় ২৫ শতাংশ পুড়ে যায়। চোখে পড়েছে কেমিক্যালের ছিটা। পুরো পা ও শরীরের অনেকখানি অংশই ঝলসে গেছে। সাইদুরের মা বলেন, ঘুমের মধ্যে ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার করে ওঠে আমার ছেলে।

হাসপাতাল ছাড়লেও চট্টগ্রামের বিস্ফোরণে আহতদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আরেক আতঙ্ক 1

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর কন্টেইনার বিস্ফোরণে আহত অনেক রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘটনার পর ২৩০ জনকে হাসপাতালে আনা হলেও গত তিন দিনে ১৬৭ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তবে এসব রোগী শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলেও এখনও সেই বিভীষিকা তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সবমিলিয়ে দেড়শতাধিক মানুষ মানসিকভাবে এখনও অসুস্থ। সুস্থ হওয়ার পর ছয় মাস ট্রমা-পরবর্তী সময়ে তাদের মানসিক কাউন্সিলিং দরকার বলে জানান মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

আগুনে পোড়া এসব রোগীর শরীর ও চোখের চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসারও দরকার বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের মানসিক রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. পঞ্চানন আচার্য্য। তিনি মনে করেন, রোগী সুস্থ হওয়ার পর চট্টগ্রাম মেডিকেলের মানসিক ওয়ার্ডেই তাদের চিকিৎসা করানো যেতে পারে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনও বড় দুর্ঘটনার পরই ভুক্তভোগীরা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেসে বা মানসিক চাপে ভুগতে শুরু করেন। দুর্ঘটনার বিভীষিকার স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে তাদের মনে। ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেন না। দুঃস্বপ্ন দেখেন। মনে হয়, জীবন শেষ হয়ে গেছে।

যারা নিজে থেকে বা কারও সহায়তায় বা মানসিক চিকিৎসায় মাসখানেকের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন, তাদের সমস্যা মিটে যায়। যারা পারেন না, তারা হয় নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সুযোগ খোঁজেন, নয়তো অর্ধোন্মাদ হয়ে জীবন কাটাতে থাকেন। দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেস পুরোদস্তুর ডিজঅর্ডারে পরিণত হয়। যার নাম ‘পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার’ বা পিটিএসডি।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন মোহাম্মদ ফারুক। তিনি বিএম ডিপোর গাড়িচালক ছিলেন। এখনও পর্যন্ত তিনি চোখ মেলতে পারছেন না। তবে আগের চেয়ে একটু ভালো অনুভব করছেন। তার স্ত্রী ফাতেমা বলেন, ‘আমার স্বামী আগুনের স্মৃতিকে ভুলতে পারছে না। বারবার বলেছেন, আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।’

খুলনার আমিন উদ্দিন গাড়ি নিয়ে বিএম ডিপোতে আসেন পণ্য নিতে। বিস্ফোরণের পর কৌতুহলবশত আগুন দেখতে গিয়ে দগ্ধ হন। এরপর কন্টেইনার বিস্ফোরণ হলে তিনি জ্ঞান হারান। জ্ঞান যখন ফিরে দেখেন তিনি হাসপাতালে। তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম জানান, ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠছে আমিন। বার বার বলেছেন, ‘আমি বেঁচে ফিরছি।’

বিএম ডিপোর আরেক গাড়িচালক মো. বাবুল অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন। চোখ মেলাতে পারছে না, শ্বাসকষ্টও আছে তার। তবে এখন কথা বলতে পারছেন। তিনি সবসময় আগুন নিয়েই কথা বলছেন, ভয় পাচ্ছেন বলে জানান বাবুলের স্ত্রী পারু।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪৩ জন। বিস্ফোরণের পর ২৩০ জনকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭৫ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এরপর ১৫৫ জনকে ভর্তি করা হয়। এরমধ্যে কয়েকদিনে আরও ৯২ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত চিকিৎসাধীন আছে ৬৩ জন।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের মানসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. পঞ্চানন আচার্য্য বলেন, ‘আগুনে পোড়া রোগীরা শারীরিকভাবে সুস্থ হওয়ার কিছু সময় পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তারা ভাবেন, আর হয়তো কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। এই সময় তাদের পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা ও চিকিৎসকদের কাউন্সিলিংয়ের দরকার হয়।’

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘হঠাৎ করে যখন কেউ বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হন, সে প্রথমে অনেক কিছুই বুঝতে পারেন না। তাদের অনেকে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ছে বা চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে বলে ভাবেন। এটা মানসিকভাবে তাদের ভীষণ প্রভাবিত করে। এরপর জীবন-জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় তাদের। আর এভাবেই তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অনেক সময় সুস্থ হওয়ার পর ৬ মাস পর্যন্ত মানসিকভাবে অসুস্থ থাকেন তারা। এটি হচ্ছে ট্রমা-পরবর্তী সময়। একে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বলে।’

যেহেতু মেডিকেলে একটি মানসিক ওয়ার্ড রয়েছে সেখানে তাদের চিকিৎসা ও কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে জানান ডা. পঞ্চানন আচার্য্য।

ডিজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!