চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে ৩০ বছরের পুরনো বিপজ্জনক রাসায়নিকও, চিঠি চালাচালিই সার

৩০ বছর আগে ১৯৯২ সালে আনা বিপজ্জনক রাসায়নিক পণ্যের চালান এখনও পড়ে আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু রাসায়নিক পণ্য ধ্বংস বা নিলামে বিক্রি করা হলেও এখনও পড়ে আছে ২০৯ কনটেইনার বিপজ্জনক পণ্য। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো কনটেইনারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও সরানো হচ্ছে না রাসায়নিকসহ বিপজ্জনক পণ্যগুলো। কিছু চালানে মামলা সংক্রান্ত বিষয় থাকায় সরানো বা ধ্বংস অথবা নিলাম করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দরের তৈরি করা তালিকায় পি-শেডের ২৮টি লট করা হয়। ওই তালিকায় একটি লটে রয়েছে ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে আনা নাইট্রিক এসিড। এ নাইট্রিক এসিড খুবই বিপজ্জনক রাসায়নিক। এক কনটেইনারে ১ হাজার কেজি বা এক মেট্রিক টন ওজনের নাইট্রিক এসিডের চালানটি বন্দরে পড়ে আছে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে।

চট্টগ্রাম বন্দরের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৯২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বড় জাহাজ এমভি অফটিমা জাহাজে করে আনা নাইট্রিক এসিডের চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরের রিসিভ করা হয়। চালানটি ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময় হিসাব করলে দেখা যায় প্রায় ৩০ বছর ৫ মাস ধরে বন্দরের পি শেডে রয়েছে। এ চালানটি গত ২০১৮ সালে একবার নিলামে তোলার জন্য ইনভেন্ট্রি করা হয়েছিল। কিন্তু নিলামে সেটি বিক্রি হয়নি। রাসায়নিক এ পণ্যটি বর্তমানে ধ্বংসযোগ্য হিসেবে ‘রিমার্ক’ করা রয়েছে।

এটিই শুধু নয়, ‘এস এম পাউডার’ নামের আরেকটি রাসায়নিক পণ্যের চালান চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়েছিল ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর । ৪০ ফুটের কনটেইনারটি রাখা আছে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ডে। কনটেইনারের ভেতরে থাকা রাসায়নিক পণ্যটি নষ্ট হয়ে গেছে বহু আগেই। বড় জাহাজ লংকা মাহাপোলা জাহাজে ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর আইটিএইউ ৫৩৪৮৮৫৩ কনটেইনারটি আনা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে।

চট্টগ্রাম বন্দরের ৮ নম্বর শেডে পড়ে আছে আরেকটি বিপজ্জনক পণ্য ‘কসটিক সোডা’। ২ হাজার ব্যাগে ১০১ মেট্রিক টন কসটিক সোডা চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে ১০ জুলাই। গুণগত মান নষ্ট হয়ে অনেক আগে থেকেই বিপজ্জনক পণ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ওই চালানটি।

জানা গেছে, ‘এস এম পাউডার’ ও ‘কসটিক সোডা’ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে ২৮ বছর আগে। এ দুটিই বর্তমানে ধ্বংসযোগ্য পণ্য হিসেবে রয়েছে বন্দরে।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দরে বর্তমানে ২০৯ টিইইউএস বিপজ্জনক কনটেইনার রয়েছে। এর মধ্যে বন্দরের ৩ নম্বর ইয়ার্ডে একটি, ৭ নম্বর ইয়ার্ডে পাঁচটি, ৮ নম্বর ইয়ার্ডে ৫৫টি, জেআর-এ ৬টি, সিসিটিতে ২৬টি, এনসিটিতে ৯০টি, ওভার ফ্লো ইয়ার্ডে ১০টি, এসসি ইয়ার্ডে ১৬টি বিপজ্জনক কনটেইনার রয়েছে।

এদিকে, বিপুল পরিমাণ বিপজ্জনক পণ্য নিয়ে বিপাকে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের পর বন্দরের অভ্যন্তরে থাকা কেমিক্যাল পণ্য নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু হয়েছে । চট্টগ্রাম কাস্টমসকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে বন্দর থেকে। এ কারণে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের চালান স্পট নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা নিয়েছে।

তবে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছাড়াও বন্দরের ভেতরে নিলামযোগ্য রাসায়নিক পণ্যের অনেক স্তূপ দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকার কারণে ঝুঁকির মুখে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।
গত ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহজাহান (এনপিপি) নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বন্দরে বিপুল পরিমাণ নিলাম ও ধ্বংসযোগ্য পণ্য বা বিপজ্জনক পণ্য সরানোর কথা উল্লেখ করেন। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এর আগেও এ বিষয়ে চিঠি চালাচলি করা হলেও এসব বিপজ্জনক পণ্যের বিষয়ে শুল্ক বিভাগ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

এর আগে, ২০২০ সালে লেবাননের বৈরুত বন্দরে বিপজ্জনক পণ্যের ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটলে বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। বিপজ্জনক কিছু পণ্য সিলেটের সুনামগঞ্জের একটি সিমেন্ট কারখানায় নিয়ে ধ্বংস করা হয়। পরে এ উদ্যোগ চলে ঢিমেতালে। বিপজ্জনক পণ্য সরানোর বিষয়টি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

এদিকে সীতাকুণ্ডে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরণের পর আবার টনক নড়ে দুই সংস্থার। শনিবার (৪ জুন) রাতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। এ ঘটনার পর বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় পত্র চালাচালি করে বিপজ্জনক পণ্য সরানো নিয়ে। বন্দরের নানামুখী তৎপরতার কারণে কাস্টমস বিপজ্জনক পণ্যগুলো নিলাম ও ধ্বংসের জন্য তৎপরতা শুরু করে। চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা ৬০৯ ড্রামে ৩০ মেট্রিকটন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড তড়িঘড়ি স্পট নিলাম দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস।

চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘মামলা সংক্রান্ত সমস্যা থাকায় বেশ কিছু পণ্য নিলাম বা ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এরপরও আমি চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ পরিমাণ চালান ধ্বংস ও নিলাম করেছি। আগে যেখানে ৮ হাজার কনটেইনার ছিল, সেখানে নিলামযোগ্য কনটেইনার অর্ধেকে নেমে এসেছে। এরপরও আমি পুরাতন গোলা খালি করে ওখানে বিপজ্জনক পণ্যগুলো স্থানান্তরের ব্যবস্থা করছি।’

কাস্টমস কমিশনার বলেন, ‘মঙ্গলবারও তিনটি কনটেইনার সরানো হয়েছে। একটি কনটেইনার থেকে হালকা ধোঁয়া বের হচ্ছিল। তা সরিয়ে পুরাতন গোলায় নিয়ে আসা হয়েছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!