সড়কে মায়া হরিণ, ভবনে বানর— চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন বন্যপ্রাণীর আপনভুবন

দিনদুপুরে সড়ক বা খোলা মাঠ কিংবা ভবনের সামনে বানরের লাফালাফির দৃশ্য দেখে হয়তোবা বিস্ময়ে ছানাবড়া আপনার চোখ। ঠিক তখনই একটি মায়া হরিণকে পাহাড় থেকে নেমে চোখের পলকে যদি দৌঁড়ে পালাতে দেখেন পাশের বনে— কেমন লাগবে আপনার? সজারুর তাড়া খেয়ে ঝোঁপের আড়ালে বন মোরগের আত্মগোপন কিংবা লোকালয়ে এসে খাবারের খোঁজে হেঁটে বেড়ানো বুনো শুকরের দল দেখে পুরো ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য মনে হবে আপনার কাছে।

কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মুহূর্তে এলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে এমনই সব দৃশ্য।দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখন বন্যপ্রাণীদের এমনই একচ্ছত্র রাজত্ব। দিনদুপুরে কাটা পাহাড় সড়ক, বঙ্গবন্ধু উদ্যান কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের সামনে গেলে মনেই হবে না এটি কোনো ব্যস্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শংকায় ২০২০ সালের মার্চে বন্ধ ঘোষণা করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম ও আবাসিক হল। এরপর পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীশূন্য। গত প্রায় এক বছর ধরে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের পদচারণা নেই বললেই চলে।

আর এই সুযোগে ক্যাম্পাসে রাজত্ব তৈরি করেছে বন্যপ্রাণীর দল। একে একে দেখা মিলছে মায়া হরিণ, শুকর, বানর, সজারু, বনমোরগ, বনরুইসহ নানা প্রজাতির প্রাণীর। কখনওবা তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনওবা ছুটছে খাবারের খোঁজে, কখনওবা আবার গরু-ছাগলসহ মানুষজনকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চেনা জগতেই এমন সব দৃশ্য দেখে এসব কিছুর ছবি আর ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীরা।

সর্বশেষ, গত ২৮ জানুয়ারি দক্ষিণ ক্যাম্পাসের দোলা সরণী সংলগ্ন এলাকবায় দুটি বন্য শুকর ও বনমোরগের খাবার খাওয়ার একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রফেসর ও আইআইইউসির উপ-উপাচার্য মোহাম্মদ আজাদী।

সড়কে মায়া হরিণ, ভবনে বানর— চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন বন্যপ্রাণীর আপনভুবন 1

এর আগে গত ২৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কোয়ার্টারের পাশে একটি পেয়ারা গাছ থেকে বানরের পেয়ারা খাওয়ার ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অরুপ বড়ুয়া।

এর আগে গত বছরের নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাশার মোড় থেকে বনরুইয়ের অবাধ বিচরণের একটি দৃশ্য ভিডিও করেন মারুফ নামের এক শিক্ষার্থী।

ওই বছরের আগস্টে শহীদ আব্দুর রব হলের মাঠে বন্য শুকরের দলের ঘাস খাওয়ার একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সজীব। এতে দেখা যায় ঘাস খাওয়ার পাশাপাশি ওই দলটি মাঠের অন্যান্য গরু, ছাগলসহ মানুষজনকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

জানা যায়, কয়েক মাস ধরে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বনে ও ভবনের ছাদে কখনও একা, কখনও দলবেঁধে বিচরণ করছে বিরল প্রজাতির আসামি বানর। যার বৈজ্ঞানিক নাম (Assamese Macaque) অ্যাসামিজ ম্যাকক। কাটা পাহাড় সড়ক, আব্দুর রব হলের ছাদ, টিচার্স কোয়ার্টার, বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের সামনে এই বানরের নিয়মিত দেখা মিলছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্যমতে, ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পাসের ভেতরে কয়েকটি পাহাড়ে তিন প্রজাতির বানরের আধিক্য ছিল। লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, পিগটেল বানর দাপিয়ে বেড়াতো পুরো ক্যাম্পাস। কিন্তু এখন এসব বানর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমনকি ২০১০ সালের আগেও ক্যাম্পাসে হরিণের বিচরণ ছিলো চোখে পড়ার মতো। এই প্রাণীও এখন খুব একটা দেখা যায় না।

২০০৮ সালে প্রকাশিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ২৭ প্রজাতির প্রাণীর কথা জানা গেলেও এখন মাত্র ১৫টি প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব আছে। বাকি ১২ প্রজাতির প্রাণীই বিলুপ্ত।

বিশ্বিবদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর মো. ফরিদ আহসানের মতে, ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী বানরের এই প্রজাতি বাংলাদেশে বিলুপ্ত। তাই এটির সংরক্ষণ খুব জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় ওদের থাকার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। লোকজন যেহেতু কম, তাই ওরা এখানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। এরা মূলত ফল এবং কচি লতাপাতা খায়। ক্যাম্পাসে খাবারগুলো আছে। নিরাপদ পরিবেশ পেলে এখানে বংশবিস্তারও করতে পারে। এদের রক্ষা করা জরুরি।’

প্রাণীবিদ্যা বিভাগের আরেক প্রফেসর ড. গাজী সৈয়দ আসমত বলেন, ‘ক্যাম্পাস দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার বানর-হরিণের দেখা মিলছে। কারণ ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় অনেক গাছও নতুনভাবে জন্মাচ্ছে। পাখিরাও ক্যাম্পাসজুড়ে বিচরণ করছে।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হলো প্রাণীর জন্য ‘সুপার হটস্পট’। কারণ ছোট্ট এ জায়গায় যে পরিমাণ প্রাণী বসবাস করে— তা অবিশ্বাস্য। ক্যাম্পাস খুললেও যদি আমরা গাছ না কাটি, পাহাড় কেটে সড়ক তৈরি না করি তাহলে বন্যপ্রাণী বৃদ্ধি পেতে থাকবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!