স্বল্প পুঁজি নিয়েও বাংলাদেশের লড়াই করে হার

নিউজিল্যান্ডের ২ উইকেটে জয়

এক সময় বাংলাদেশ দলের খেলার সাথে ‘ইশ’ শব্দটি বেশ ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছিল। অধুনা টাইগারদের দারুণ সব শিকারে ‘ইশ’ শব্দটি দলের সমর্থকরা প্রায় ভুলে গেছেন। বিশ্বকাপে বুধবার (৫ জুন) নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে ওভালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেটি আবার ফিরিয়ে আনলো বাংলাদেশ।
‘ইশ! যদি তখন রানআউট হয়ে যেতেন উইলিয়ামসন। যদি মুশফিক সে ভুলটা না করতেন!’- নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভক্ত-সমর্থকদের প্রায় সবার কণ্ঠেই শুধু এই একটি কথা। নিজের ইনিংসের শুরুতেই মুশফিকুর রহীমের বাচ্চাসুলভ ভুলে নিশ্চিত রানআউটের হাত থেকে বেঁচে যান কিউই অধিনায়ক।

স্বল্প পুঁজি নিয়েও বাংলাদেশের লড়াই করে হার 1
মুশফিকের এই সহজ রান আউট মিস না করলে ম্যাচের রেজাল্ট অন্যরকমও হতে পারতো বলে অনেকের ধারণা

পরে রস টেলরের সঙ্গে গড়েন ম্যাচ জেতানো ১০৫ রানের জুটি, অথচ তিনি সাজঘরে ফিরতে পারতেন জুটির মাত্র ৬ রানের মাথায়। তবু উইলিয়ামসনের এ ঘটনার পরেও সাকিব, মিরাজ, মোসাদ্দেকদের বোলিংয়ে ম্যাচ জমিয়ে তুলেছিল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের করা ২৪৪ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই দুই ডানহাতি বোলার মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং মেহেদী হাসান মিরাজের ওপর চড়াও হন গাপটিল। মাত্র ৫ ওভারে নিয়ে নেন ৩৫ রান।

উপায়অন্ত না দেখে ষষ্ঠ ওভারেই নিজের ডেপুটির হাতে বল তুলে দেন অধিনায়ক মাশরাফি। আস্থার প্রতিদান দিতে দ্বিতীয় বল পর্যন্তও যাননি সাকিব।

ব্যাট হাতে ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, দলকে বলার মতো সংগ্রহ এনে দেয়ার পথে তার ৬৪ রানের ইনিংসের ছিলো অগ্রণী ভূমিকা। তবে তিনি তো অলরাউন্ডার, শুধু ব্যাটিং দিয়ে কি আর হয়? না, হয়নি সাকিব আল হাসানের। বল হাতে নিয়ে নিজের প্রথম বলেই ভয়ঙ্কর মার্টিন গাপটিলকে সাজঘরে পাঠিয়েছেন বিশ্বসেরা এ অলরাউন্ডার। সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনকেও আউট করার।

সাকিবের করা প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টা করেন গাপটিল। কিন্তু ধরা পড়ে যান লংঅনে দাঁড়ানো তামিম ইকবালের হাতে। আউট হওয়ার আগে ৩ চার ও ১ ছয়ের মারে ১৪ বলে ২৫ রান করেন গাপটিল।

এদিকে গাপটিল ফিরে গেলেও ঝড়ো ব্যাটিং চালিয়ে যান কলিন মুনরো। তাই তো মাত্র সপ্তম ওভারেই দলীয় পঞ্চাশ পূরণ করে ফেলে তারা। তবে সাকিব আল হাসান ও মেহেদী মিরাজের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের বিপক্ষে হাঁসফাঁস করতে করতে বেশিক্ষণ থাকা হয়নি মুনরোর।

ইনিংসের দশম ওভারের শেষ বলে সাকিবের বোলিংয়ে মিরাজের দারুণ ক্যাচে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফেরেন ৩৪ বলে ২৪ রান করা মুনরো। এরপরই হাল ধরেন টেলর এবং উইলিয়ামসন, গড়েন ১০৫ রানের জুটি। অথচ তাদের জুটিটা ভাঙতে পারতো মাত্র ৬ রানের মাথায়।

ইনিংসের দ্বাদশ ওভারের দ্বিতীয় বলের ঘটনা। সদ্যই উইকেটে আসা রস টেলরের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বিপদে পড়ে যান অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। মিড অফ থেকে তামিম ইকবালের থ্রো ধরে উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহীম যখন উইকেট ভেঙে দেন, তখনো পপিং ক্রিজের অনেক বাইরে উইলিয়ামসন।

ঘটনাটা হতে পারতো এমন। কিন্তু টাইগার উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহীম করে বসেন বাচ্চাসুলভ ভুল। তামিমের করা থ্রোটি সরাসরি ছিলো উইকেট বরাবরই। কিন্তু বাড়তি সতর্কতা নিতে গিয়ে স্ট্যাম্পের সামনে এসে বল ধরে উইকেট ভাঙতে যান মুশফিক। ঠিক তখন তার হাতে লেগে আগেই পড়ে যায় বেলস।

যে কারণে পরে তিনি বল গ্লাভসে জমিয়ে উইকেট ভাঙলেও এবং কেন উইলিয়ামসন নিজের ক্রিকের অনেক বাইরে থাকলেও, বেঁচে যান রানআউট থেকে। আর এ জীবন কাজে লাগিয়ে নিজের দলকে জয়ের দিকে পরিচালিত করে নিয়ে যাচ্ছেন কিউই অধিনায়ক।

দ্বাদশ ওভারে যখন ঘটে এ ঘটনা, তখন ১৬ বল খেলে মাত্র ৮ রান করেছিলেন উইলিয়ামসন। নিউজিল্যান্ডের রান তখন ১১.২ ওভারে ২ উইকেটে ৬১ রান। উইলিয়ামসনের উইকেটটি তখন পড়লে স্কোরকার্ড রূপ নিতো ৩ উইকেটে ৬১ রানে। সেটি হয়নি মুশফিকের ভুলের কারণে।

উইলিয়ামসনকে আউট করতে অপেক্ষায় করতে হয় ৩২তম ওভার পর্যন্ত। সে ওভারের প্রথম বলে অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনকে এবং শেষ বলে উইকেটরক্ষক টম লাথামকে ডিপ মিডউইকেটে ক্যাচে পরিণত করেন মেহেদী মিরাজ। তাতেই জমে উঠতে শুরু করে নিউজিল্যান্ডের হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ।

মুশফিকুর রহীমের বাচ্চাসুলভ ভুলের কারণে জীবন পেয়ে রস টেলরের সঙ্গে ১০৫ রানের জুটি গড়েন কিউই অধিনায়ক উইলিয়ামসন। তবে নিজে কখনোই সে অর্থে হাত খুলে খেলতে পারেননি, আড়ষ্ট ছিলেন পুরো ইনিংসেই।

স্বল্প পুঁজি নিয়েও বাংলাদেশের লড়াই করে হার 2
রস টেইলরের অনবদ্য ইনিংসে লড়াই করে জয় পায় কিউইরা।

৩২তম ওভারে মেহেদী মিরাজকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন মিডউইকেটে দাঁড়ানো মোসাদ্দেক সৈকতের হাতে। আউট হওয়ার আগে ৭২ বলে ৪০ রান করেন উইলিয়ামসন। সে ওভারেরই শেষ বলে বাঁহাতি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান লাথামও চেষ্টা করেন একই অঞ্চলে বড় শট খেলার।

কিন্তু তিনি ধরা পড়ে যান মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের হাতে। রানের খাতাই খুলতে ব্যর্থ হন লাথাম। মিরাজের এ জোড়া আঘাতে ফিরে আসে ম্যাচের প্রাণ।

পানি পানের বিরতির সময় মোসাদ্দেক সৈকতকে বোলিংয়ের নানান পরামর্শ দিচ্ছিলেন সাকিব আল হাসান। যা কাজে লেগে যায় একদম সঙ্গে সঙ্গে। ইনিংসের ৩৯তম ওভারে উইকেটে টিকে থাকা রস টেলরের উইকেট তুলে নেন মোসাদ্দেক। আউট হওয়ার আগে ৯১ বলে ৮২ রান করেন টেলর।

পরে কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমকে (১৩ বলে ১৫) মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন এবং জিমি নিশামকে (৩৩ বলে ২৫) সাজঘরে পাঠান মোসাদ্দেক। কিন্তু মিচেল স্যান্টনার একপ্রান্ত ধরে রেখে এগিয়ে নেন দলকে। তবু ৪৭তম ওভারে ম্যাট হেনরিকে সরাসরি বোল্ড করে ফের আশা জাগিয়েছিলেন সাইফউদ্দিন।

মোস্তাফিজের করা ৪৮তম ওভারের প্রথম বলে বাউন্ডারি মেরে জয় নিশ্চিত করেন ১২ বলে ১৭ রান করা স্যান্টনার। টাইগারদের পক্ষে বল হাতে ২টি করে উইকেট নেন মেহেদী মিরাজ, সাকিব, মোসাদ্দেক ও সাইফউদ্দিন।

বিশ্বকাপের লড়াইয়ে বাংলাদেশ আগের চার মোকাবেলায় কখনোই হারাতে পারেনি নিউজিল্যান্ডকে। অজেয় থাকার নিউজিল্যান্ডের সেই রেকর্ডটা অক্ষুন্ন রইলো। বিশ্বকাপে দু’দলের পঞ্চম মোকাবেলায়ও নিউজিল্যান্ডই হাসলো। ২ উইকেটে হারা ম্যাচ থেকে বাংলাদেশ ফিরলো অনেক প্রশ্ন এবং একরাশ হতাশা নিয়ে।

এর আগে ব্যাটিংয়ে সম্ভাবনা জাগিয়েও ২৪৪ থেমে যায় বাংলাদেশ। ওপেনিং জুটিতে ৪৫ রান। ২২.৩ ওভারে ১০০ রান। শেষমেষ সেই ইনিংসই থেমে গেলো ২৪৪ রানে। নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জনো এটা যথেস্ট স্কোর কি? দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভরা এই প্রশ্ন নিয়েই শেষ হয়েছিল বাংলাদেশের ব্যাটিং।

আউট হওয়া শুরুর ছয় ব্যাটসম্যানের প্রত্যেকেই একই ভুলের বৃত্তে আটকে আউট হলেন। ছয় জনেই বড় যা নষ্ট করলেন তার নাম- সুন্দর সম্ভাবনা! প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্কোরই সেই প্রমান দিচ্ছে। সৌম্য ফিরলেন ২৫ বলে ২৫ রান করে। তামিম ধীরে শুরু করলেও ইনিংসটা শেষ তার ২৪ রানে। মুশফিক উইকেটে জমে গিয়ে পুরোপুরি নিজের ভুলে রান আউট হলেন। ৩৫ বলে তার ১৯ রানের ইনিংস বাংলাদেশ দলের আরেকটি দুঃখগাঁথা। সাকিব যেভাবে খেলছিলেন তাতে বিশ্বকাপে তার প্রথম সেঞ্চুরির সম্ভাবনাটা ক্রমশ সবুজ হচ্ছিলো। কিন্তু সেই সবুজে হলদে আচঁড় নিয়ে সাকিবের ইনিংস শেষ ৬৪ রানে। ৬৮ বলে ৭ বাউন্ডারিতে সাকিব এই ৬৪ রান করেন। চলতি বিশ্বকাপে এটি তার টানা দ্বিতীয় হাফসেঞ্চুরি।
স্বল্প পুঁজি নিয়েও বাংলাদেশের লড়াই করে হার 3
সম্ভাবনা নষ্ট করার অভিযোগে দুষ্ট মোহাম্মদ মিথুনের ইনিংসও। লম্বা সময় পেয়েছিলেন খেলার জন্য। উইকেটে থিঁতুও হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ৩৩ বলে ২৬ রানে আউট হওয়া ইনিংসের জন্য ‘পাসমার্ক’ও পাচ্ছেন না মিথুন।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও আগের পাঁচজনকেই অনুসরণ করলেন। ৪১ বল খেলার পর অমন শট কেন খেলবেন ‘ফিনিসার ব্যাটসম্যান’? তিনি তো তখন পুরো ৫০ ওভার পর্যন্ত খেলবেন? মোসাদ্দেক শেষের দিকে ছক্কা হাঁকানোর জন্য ভুল বোলারকে বেছে নিলেন। শটস খেললেন। তবে সেটা আকাশের অনেক উচুঁতে উঠলো। ফ্ল্যাট শটস হলো না। বাউন্ডারি লাইন থেকে দৌড়ে ভেতরে এসে ক্যাচ নিতে মার্টিন গাপটিলতে তেমন কষ্ট করতে হলো না।

উইকেটে জমে গিয়েও ব্যাটসম্যানদের বড় ইনিংস খেলতে না পারার দুঃখ কিছুটা ভোলালেন শেষের দিকে মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ব্যাটিংয়ে নেমেই নিজের ব্যাটসম্যানশিপটা দেখালেন এই অলরাউন্ডার।

বাংলাদেশের ২৪৪ রানের স্কোরে সাইফুদ্দিনের সংগ্রহ ২৯ রান। একটু মনে করিয়ে দেই সাকিবের ৬৪ রানের পর সেটাই বাংলাদেশের স্কোরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান। কোচ স্টিভ রোডস তার কাঁধে চাপড়ে দিয়ে বলছেন-ওয়েলডান বয়!

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!