সাঈদী মারা গেলেন, চিকিৎসা বিফল একদিনেই

কারাগার থেকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার একদিনের মাথায় মারা গেলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে-আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

সোমবার (১৪ আগস্ট) রাত ৮ টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একজন বাংলাদেশি ইসলামী পণ্ডিত, বক্তা এবং রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য; যাকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থেকে হত্যার মতো মানবতাবিরোধী কার্যক্রমে সাহায্য করার অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে-আমির। তিনি ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবার এবং ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

রোববার (১৩ আগস্ট) বিকেলে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১ বন্দি আছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। সেখানে থাকা অবস্থায় রোববার বিকালে তিনি বুকের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

ওই সময় তার ছেলে মাসুদ সাঈদী বলেন, ‘আপনারা জানেন যে আমার বাবার হার্টে পাঁচটি রিং পরানো ছিল। কারাগারে তিনি অসুস্থ হলে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে গাজীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার দায়িত্ব চিকিৎসকরা তাকে ঢাকাতে রেফার্ড করেন। উনাকে এখন এই পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। উনি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান আছেন। আন-অফিসিয়ালিভাবে জানতে পেরেছি তিনি মাইন্ড স্ট্রোক করেছেন।’

দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬২ সালে ছারছিনা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন ও পরবর্তিতে খুলনা আলিয়া মাদ্রাসায় স্থানান্তরিত হন। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের পর সাঈদী স্থানীয় গ্রামে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি মুসলমান আলেম বা মওলানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছর। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচারে তাকে ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে মানবাতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। দবে তার পুত্র মাসঊদ সাঈদীর মতে তিনি ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে ছিলেন না এবং ১৯৬৯ সাল থেকে তিনি যশোরে বসবাস করছিলেন।

১৯৮০’র দশকের প্রথমদিকে সাঈদী সাড়াদেশব্যাপী ইসলামী ওয়াজ-মাহফিল ও তাফসির করা শুরু করেন এবং দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ সময়ই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী জোট গঠন করে এবং তিনি এই নির্বাচনে পুনরায় জাতীয় সংসদ-এর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সাঈদী ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রশক্তি দ্বারা পরিচালিত আফগানিস্তানের তালেবান সরকার উৎক্ষাত ও আল কায়েদা নির্মূল অভিযানের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে একটি স্বাধীন মুসলমান রাষ্ট্রের সরকারের উপর হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন। আল কায়েদাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ হামলার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়ে থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি সাঈদীর চরমপন্থী মতবাদের জন্য ২০০৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেরোরিস্ট স্ক্রিনিং সেন্টার (টিএসসি) সাঈদীকে তাদের নো ফ্লাই তালিকায় যুক্ত করে অর্থাৎ এই তালিকার নাগরিকেরা কোন দেশ থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রবেশ করতে পারেন না।

২০১১ সালে সাঈদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়। তার বিরূদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটতরাজ ও সংখ্যালঘু হিন্দুদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের ২০ দফা অভিযোগ আনা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০টি অভিযোগের মধ্যে প্রদত্ত বিচারের রায়ে আটটি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তার ফাঁসির রায় ঘোষণা হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ও সহিংসতা শুরু করে। ওই রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ আদালত আপিলের রায় পর্যবেক্ষণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির সাজা কমিয়ে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদন্ড দেন। সেই থেকে তিনি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারেই ছিলেন।

দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর স্ত্রীর নাম শেখ সালেহা বেগম। তার চার সন্তান হলেন— রাফিক বিন সাঈদী, শামীম সাঈদী, মাসঊদ সাঈদী ও নাসিম সাঈদী।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!