সন্দ্বীপে শিক্ষকের জায়গা দখল, চেয়ারম্যানের পক্ষে আগের মালিকের সাফাই

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে ভুয়া দলিল তৈরি করে এক স্কুল শিক্ষকের পরিবারের কবরস্থানের জায়গা ও দোকান ভিটা দখল করার অভিযোগ ওঠা মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ও তার ভাইয়ের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেছেন জমিটির আগের মালিক হোসনে আরা বেগম।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন হোসনে আরার মেয়ে রহিমা বেগম। এ সময় ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া মঞ্জুর ও মো. মেহেরাজ মেম্বার তাদের সাথে উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে রহিমা বেগম দাবি করেন ২০০১ সালের পর মাজহারুল ইসলামরা জোর করে তার মাকে ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করেন। ২০১৬ সালে এই জমি তার মা হোসনে আরা বেগম নিজে মিজানুর রহমান ও মাকসুদুর রহমানের কাছে বিক্রি করেন।

এর একদিন আগে মাজহারুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে মিজানুর রহমান ও তার ভাই মাকছুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার প্রভাব কাজে লাগিয়ে ভুয়া দলিল তৈরি করে তার জায়গা দখলের অভিযোগ তুলেছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেছেন, হোসনে আরার কাছ থেকে ১৯৮৩ সাল ও ১৯৯৭ সালে হোসনে আরার কাছ থেকে তার বাবা ফয়েজ উল্লাহ জমিটি কিনেছলেন। সেই সময় থেকে জায়গাটি তাদের নামে নামজারি ছিল এবং তারা জমিটির খাজনা পরিশোধ করে আসছিলেন। সেই সংবাদ সম্মেলনের একদিনের মাথায় হোসনে আরা সংবাদ সম্মেলন করলেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে রহিমা বেগম বলেন, আমার মা বাক প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে আমার নানা আজিজ উল্লাহ আমার মা হোছনে আরা বেগমকে মাইটভাঙ্গা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের দেলোয়ার রাস্তা সংলগ্ন মাইটভাঙ্গা মৌজার এ-৩২ ধানের ৫৯৫ নং দাগের বিএস ১৪৬ নং খতিয়ান হতে আগত ২০২১২ নং দাগের ১৯ শতক ভূমি মৌখিকভাবে দান করে সন্তানদের অছিয়ত করে যান যাতে রেজিস্ট্রি করে আমার মাকে এসব সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর আমার নানা মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার সন্তানরা পিতার অছিয়ত মোতাবেক আমার প্রতিবন্ধি মা হোছনে আরা বেগমকে ০৯/০৯/১৯৮০ইং তারিখে রেজিষ্টি করে দানপত্র করেন। দানপত্রে স্বাক্ষর করেন আমার মামা শাহের উল্লা, কামাল উদ্দিন এবং আমার নানি দেলাপ রোজা বেগম, আমার খালা আনোয়ারা বেগম, মোমেনা বেগম ও শামীমা আকার। উক্ত দানপত্রে হাকিমের সম্মুখে স্বাক্ষর দস্তখত করেন তারা। এরপর থেকেই জায়গাটি আমার মায়ের দখলে ছিল।

২০০১ সালের পর এই জমিটি মাজহার দখল করেন অভিযোগ করে রহিমা বেগম লিখেন, ‘২০০১ সালে নির্বাচনের পর ওই জমিতে ফসল আনতে গেলে আমার মায়ের চাচাতো ভাই মাজহারুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ হোসেন ও তার ছেলে সাইফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন সহযোগী মিলে আমাদেরকে জমি দখল ছেড়ে দেবার জন্য হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। একইসাথে আমার প্রতিবন্দী মাকে ব্যাপক মারধর করে ফেলে রেখে যায় তারা। পরে এলাকাবাসী আমার মায়ের চিৎকার শুনে তাকে উদ্ধার করে। প্রতিপক্ষ মাজহারুল ইসলাম গ‍ সন্ত্রাসী প্রকৃতির ও প্রভাবশালী হওয়ায় আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলেও প্রতিকার পাইনি। উল্টো হুমকি ধমকি ও অত্যাচারের শিকার হতে থাকি। এ বিষয়ে আমার এলাকার জনপ্রতিনিধি এবং সমাজের মুরব্বিগণ অবগত আছে। গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার তাদের সতর্ক করলেও তারা বারবার একইরকম অত্যাচার করতে থাকে। তারা আমাদের নিঃস্ব করতে আমার স্বামীকে আনোয়ারার এক মহিলার সঙ্গে বিবাহের ভূয়া কাবিন সৃষ্টি করে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা মামলায় (মামলা নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ২৯১/২০১৪) ফাঁসিয়ে তিনমাস জেল খাটান। অথচ আমার স্বামী কখনো তো দূরে থাক, চট্টগ্রাম শহরেই এর আগে আসেনি। জায়গা দখলের জন্য মাজহারুলের ইসলামের যোগসাজশে এ মামলা করে আমার মাকে ঘরছাড়া করার এ ষড়যন্ত্র করা হয়। বাদি মহিলা এ যাবৎ আর আদালতে না আসায় এখনো সেই মামলা আদালতে ঝুলছে। তারা বিভিন্নভাবে হয়রানি ও নির্যাতন যাচ্ছিল। আমাদের জীবন জীবিকায় বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্থ করছিল। পরবর্তী সময়ে আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লে আর্থিক কারণে বাধ্য হয়ে আমরা উক্ত জমি বিক্রির জন্য সিদ্ধান্ত নিই। পরে জায়গা কিনতে আসা একাধিক লোকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর ২০১৬ সালে মিজানুর রহমান ও মাকসুদুর রহমানের কাছে ১৮ শতাংশ জমি সাফ কবলায় আমার মা বিক্রি করেন।’

এই ক্ষেত্রে ভূমির মালিকানা দাবি করে মাজহারের বোন শামসুন নাহার একটি মামলা করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে ভূমি অফিসের দুই সার্ভেয়ার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ‘এলাকাবাসীকে সাক্ষী রেখে’ জায়গাটি হোসনে আরার কাছে বুঝিয়ে দেয় জানিয়ে রহিমা বেগম বলেন, ‘পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় হতে পাঠানো একটি নোটিশের মাধ্যমে জানতে পারি, এ জমি দাবি করে শামসুন নাহার, স্বামী মুকুল হোসেন একটি মামলা করেছেন। মামলার পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার দুই পক্ষের দলিলাদি পর্যালোচনা ও সরোজমিনে যাচাই করে সিদ্ধান্ত দেন জমির প্রকৃত মালিক আমার মা। তাই পরিমাপের পর এলাকাবাসীকে স্বাক্ষী রেখে জমিটি আমাদের বলে বুঝিয়ে দেন।’

রহিমা বেগম বলেন, ‘পরবর্তীতে মাজহারুল ইসলাম বাদি হয়ে জায়গাটি নিজের দাবি করে চট্টগ্রাম জজ কোর্টের দ্বিতীয় আদালতে দুটি মামলা করেন। এর মধ্যে একটিতে নিষেধাজ্ঞা মামলা, অপরটি ডিগ্রি পাওয়ার মামলা। নোটিশ পাওয়ার পর মিজানুর রহমান এবং মাকসুদুর রহমান উপযুক্ত দলিলপত্র সহকারে জবাব দেয়াতে নিষেধাজ্ঞা মামলাটি আদালত খারিজ করে দেয়। দ্বিতীয় মামলাটি বর্তমানে সন্দ্বীপ সহকারি জজ আদালতে স্থানান্তরিত হয়ে বিচারাধীন রয়েছে।’

মাহজারের এমন অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে রহিমা বেগম বলেন, ‘এমতাবস্থায় গত ১ আগস্ট সোমবার আমরা জানতে পারি মাজহারুল ইসলাম, শামসুন নাহার বেগম ও তাদের সঙ্গী মার্শাল, শাহাদাতসহ একটি পক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, আমার মায়ের বিক্রিত জায়গাটি খরিদদার মিজানুর রহমান ও মাকসুদুর রহমান জোরপূর্বক দখল করেছেন যা পুরোপুরি সাজানো মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ আমার মা ওই জমিটি বিক্রির পর মিজানুর রহমান ও মাকসুদুর রহমান ওই জমির খতিয়ান সৃজন পূর্বক নিয়মিত খাজনা প্রদান করে আসছেন। ওই জমির বিক্রেতা হিসেবে আমার মা ও আমি মাজহারুল ইসলাম গংয়ের সংবাদ সম্মেলনের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।’

তবে রহিমার বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মাজহার বলেন, ‘আমি ২৮ বছর ধরে স্কুল শিক্ষকতা করছি। আর জমিটা আমরা কিনেছি ১৯৮৩ আর ১৯৯৭ সালে। তখন থেকেই আমাদের নামে নামজারি। আমরা খাজনা দেই। অথচ সংবাদ সম্মেলনে বলা হইছে এটা আমরা ২০০১ সালের পর দখল করছি। শুধু এটুকু অংশই যথেষ্ট কে সত্য বলছে তা বুঝার জন্য। তাছাড়া চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত বিরোধে যখন ইউপি মেম্বাররাও সংবাদ সম্মেলনে হাজির থাকে তখনতো ব্যাপারটা বুঝাই যায় কিভাবে ক্ষমতাকে কাজে লাগাচ্ছে।’

মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবা ১৯৮৩ ও ১৯৯৭ সালে জায়গাটা কিনেছেন। পৈত্রিক সূত্রে আমরা জায়গাটা পেয়েছি। সেই জায়গা দখল করতে এখন আমাকে শিবির বানানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে ২০০১ সালের পর আমরা জায়গাটা দখল করছি। কথা হলো যে জমি আমরা ১৯৮৩ সালে কিনেছি সেই জমি কেন আমরা ২০০১ সালের পর দখল করতে যাবো? তিনি মূলত রাজনৈতিক রঙ লাগিয়ে আমার জায়গাটা দখল করেছেন। আমি কাল সংবাদ সম্মেলনে যে অভিযোগ করেছি তিনি সেটা আজ প্রমাণ করে গেলেন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!