আনন্দবাজারে ময়লার স্তূপের নিচে চাপা পড়ছে নদীভাঙা শিশুদের রঙিন স্বপ্ন

বাবা-মায়ের কলহে বেড়ে ওঠা শিশুরা মাদকে ঝুঁকছে

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আনন্দবাজার এলাকায় কয়েক একর জায়গা জুড়ে পাহাড়সম সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ডিপো। ময়লা নিয়ে গাড়ি আসার সাথে সাথে গাড়ির পিছু পিছু ছুটছে একদল শিশু। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে— কার আগে কে বেশি প্লাস্টিক বোতল কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে পারবে। দম বন্ধ হয়ে আসা দুর্গন্ধের মাঝে ময়লা ঘেঁটে প্লাস্টিকের খালি বোতল কুড়িয়ে বস্তায় ভরছে হাসান নামে ১২ বছরের এক শিশু। এটা করতে গিয়ে অসুখ হয়ে যাবে কিনা তার— এ নিয়ে ভাবার সময় নেই তার। কোনো সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার ছাড়াই ময়লা ঘেঁটে বোতল কুড়িয়ে বস্তায় ভরে যাচ্ছিল সে। খানিক বাদে সেই ময়লা হাতে খাবারও খাচ্ছিল হাসানসহ তার সঙ্গীরা।

হাসান একা নয়, তার মত আরও কয়েক হাজার শিশুর খাবার জোগাড়ের জন্য একমাত্র আয়ের উৎস এই ময়লার ডিপো। ময়লার ডিপোতে কর্মরত এসব শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ বলতে গেলে কিছুই নেই। ফলে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে এসব শিশুর জীবন।

সরজমিনে ৩০ আগস্ট (সোমবার) সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম নগরীর আনন্দবাজার ময়লার ডিপো এলাকায় কথা হয় আকবর (১১), মিরাজ (১৩), রাব্বি (১৪), শুক্কুর (১২), জিয়া (১০), আরাফাত (৯), রাসেলসহ (১৩) আরও কয়েকজনের সঙ্গে। আলাপকালে তারা জানায়, পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে তাদের কেউই প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ভর্তি হয়নি। নদীভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসা এ শিশুগুলোর ভাগ্য বদলে গেছে মুহূর্তেই, পাল্টে গেছে জীবনের চিত্রও।

আনন্দবাজারে ময়লার স্তূপের নিচে চাপা পড়ছে নদীভাঙা শিশুদের রঙিন স্বপ্ন 1

পাহাড়সমান ময়লার স্তুপের নিচে চাপা পড়ে গেছে তাদের আগামী দিনের রঙিন স্বপ্নগুলো আর আলোকিত মানুষ হবার সব আশা-আকাঙ্খা। নদী শুধু তাদের বসতভিটাই ভাঙেনি, ভেঙেছে এইসব শিশুর স্বপ্নগুলোও।

আনন্দবাজার ময়লার ডিপো এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ময়লার ডিপো সংলগ্ন টি জি কলোনিতে প্রায় ৩৫০০ পরিবারের ১৫ হাজার মানুষের বসবাস করছে। ওই ১৫ হাজার মানুষের মাঝে বেশিরভাগই নিরক্ষর। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার শিশু। এ শিশুরাও বঞ্চিত সাধারণ শিক্ষা থেকে।

জানা যায়, ৩৫০০ পরিবারের মধ্যে অধিকাংশ পরিবার বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা নদীর ভাঙনে তাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙা মানুষগুলো সর্বস্ব হারিয়ে বেঁচে থাকার আশায় জীবন জীবিকার তাগিদে চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছেন। এখানে রয়েছে ভোলা, লক্ষ্মীপুর, হাতিয়া, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ। এখন তারা সবাই ভূমিহীন। শহরে এসে ঠাঁই নিলেও নির্দিষ্ট কোনো কাজের সুযোগ নেই তাদের। ফলে তারা নগরের ভাসমান মানুষে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা—২০১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে দেশের মোট বস্তির মধ্যে ১৬ শতাংশ বা ২ হাজার ২১৬টিই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায়। ওই শুমারির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ বস্তিবাসী রয়েছে। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দারিদ্র্যের কারণে বস্তিতে এসেছে ২৯ শতাংশ মানুষ। এর বাইরে নদীভাঙন, নিরাপত্তাহীনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিবাহবিচ্ছেদও এর অন্যতম কারণ।

আনন্দবাজারে ময়লার স্তূপের নিচে চাপা পড়ছে নদীভাঙা শিশুদের রঙিন স্বপ্ন 2

আনন্দবাজার ময়লার ডিপো এলাকার বাসিন্দা মাসুমা বেগম (৫০) বলেন, ‘ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন এলাকার মলমতোরা গ্রামে আমার জন্ম। স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ সুখের সংসার ছিল। ২০১৫ সালে চোখের সামনে মেঘনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বসতবাড়ি, ফসল, গবাদি পশু, গাছপালাসহ বাপ-দাদা ও আত্বীয় স্বজনের ভিটেমাটি। তছনছ হয়ে যায় আমার মত হাজারও মানুষের কপাল। এখন পরিবারের সবাই মিলে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে সংসার চালাই।’

বাবা-মায়ের কলহে বেড়ে ওঠা শিশুরা মাদকে ঝুঁকছে

প্রতিদিন বোতল কুড়িয়ে ৮০ থেকে ১০০ টাকা আয় করে একজন শিশু। মাসে প্রায় ৩ হাজার টাকা। আনন্দবাজারে প্রায় ৫ হাজার শিশুর মধ্যে কিছু কিছু শিশু তাদের সংসারে বাবা-মায়ের হাতে টাকা দিলেও অধিকাংশ শিশু দিনের পর দিন জড়িয়ে পড়ছে মাদকের সাথে। গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, সিসা, ড্যান্ডি, ইয়াবা, পেথিড্রিনসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত তারা। এসব মাদক নেওয়ার কারণে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এদেকে হরহামেশাই ঘটছে বস্তিতে বসবাসকারী কিশোরী ও শিশুদের মধ্যে অহরহ বাল্যবিবাহের ঘটনা।

আনন্দবাজারের মত নগরের বিভিন্ন বস্তিতে প্রায় প্রতিটি পরিবারে শিশুরা বেড়ে ওঠছে পারিবারিক কলহের মধ্য দিয়ে। সকাল-সন্ধ্যা অনেক পরিবারে পিতা-মাতার ঝগড়া দেখে শিশুরা ভয়ে আতংকিত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ ধরনের কলহের মূলে রয়েছে পিতার একাধিক বিয়ে, কিছু কিছু গৃহকর্তা কোনো কাজকর্ম না করে অলস সময় কাটানোর পাশাপাশি মাদক সেবনের টাকার জন্য স্ত্রীর সাথে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। আবার কেউ কেউ সারাদিন কাজ করে যা আয় করেন, তা জুয়া খেলার পিছনে ব্যয় করেন।

শিশুসন্তানের চোখের সামনেই মাদকাসক্ত পিতা তাদের মায়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার পাশাপাশি কর্মস্থলে যাওয়া স্ত্রীকেও সন্দেহ করেন। এসব কারণে বাড়ছে পারিবারিক কলহ। এখানে যেমন বিবাহবিচ্ছেদের মত ঘটনা এখানে প্রায় নিয়মিত ঘটনা। আবার এসব কারণে বস্তিতে প্রায় সময় অশান্তি লেগেই থাকে। এতে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

স্থানীয় সমাজসেবক মো. ইব্রাহীম ফরাজী বলেন, সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশু পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ওরা বেড়ে উঠছে অযত্ন আর অবহেলায়। ওদের স্বাস্থ্যসেবা, লেখাপড়া, কারিগরি শিক্ষা খুবই প্রয়োজন। দিন দিন তারা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত ও অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অল্প বয়সে জড়িয়ে পড়ছে নানা অসামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মাদকের সাথে।

কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, বিশ্বজুড়ে শিশুদের নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করণে জলবায়ু পরিবর্তন প্রধান অন্তরায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় ও খুব বেশি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার গরিব পরিবারগুলোকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আরও বেশি দারিদ্র্য ও আবাসচ্যুতির দিকে ধাবিত করছে। ফলশ্রুতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিশুরা ন্যূনতম মৌলিক অধিকার পূরণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বন্দর-ইপিজেড-পতেঙ্গা করোনা হাসপাতালের প্রধান উদ্যোক্তা ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হোসেন আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা আবর্জনার মাঝে বোতল কুড়ানো শিশুদের চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। শিশুদের প্রতিনিয়ত জ্বর, সর্দি, ডায়রিয়া, কৃমি, ডেঙ্গু, শ্বাসকষ্ট ও চর্ম রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে।

আনন্দবাজারে ময়লার স্তূপের নিচে চাপা পড়ছে নদীভাঙা শিশুদের রঙিন স্বপ্ন 3

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে পৃথিবীর আলোচিত এবং সংকটময় বিষয়গুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম। উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানে বিশ্বের সকল দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি দুই দিনব্যাপী ‘লিডার্স সামিট’ এর উদ্বোধনী সেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪০ জন বিশ্বনেতাদের পরামর্শ দেন কিভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো, জলবায়ুর ক্ষতি প্রশমন ও পুনর্বাসনে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ফান্ড নিশ্চিত করা এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া যায়।

তিনি বলেন, প্রতি বছর বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন এবং টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। যা আমাদের জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ৫০টি স্বল্পোন্নত দেশ যারা বিশ্বের ১ শতাংশের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী, তারাই এই নিঃসরণজনিত কারণে সৃষ্ট জলবায়ু সংকটের শিকার হয়। জলবায়ু কল্যাণ ট্রাষ্ট গঠন করে পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ৪ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন করেছে।

২০১৯ সালে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!