মাঝরাতে শ্বাসকষ্টে করোনা রোগী, ফেসবুকে পোস্ট দেখে ছুটলেন অচেনা দুই তরুণ

‘আজ আমার করোনা ভাইরাস পজিটিভ আসছে। এখন আমার অবস্থা খুব খারাপ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। গ্রুপের এডমিন তানভির ভাইয়ের সহযোগিতায় জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করি। উনি এই মুহূর্তে নেবুলাইজার ব্যবহার করতে বলতেছেন। আমি এত রাতে নেবুলাইজার কোথায় পাব? তাছাড়া আমার বিল্ডিং লকডাউন। গ্রুপে এমন কেউ আছেন আমাকে একটা নেবুলাইজার যোগাড় করে দিতে পারেন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’

শনিবার (২৩ মে) রাত দেড়টায় ‘করোনা আপডেট চিটাগং’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে এভাবেই সাহায্য চান করোনা পজিটিভ হয়ে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি।

গভীর রাত। ফেসবুকেও কমে এসেছে উত্তাপ। অনেকেই এ সময় গভীর ঘুমে। কিন্তু না, পোস্ট দেওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই সাড়া দিলেন একজন। একজন জানতে চাইলেন, ‘কই থাকেন আপনি?’ জবাব নেই লোকটার। এরপর ইমা নাজ নামের এক ফেসবুকার আবার জানতে চাইলেন— ‘ঠিকানা?’ তীব্র শ্বাসকষ্টে পড়ে যাওয়া লোকটির হয়তো ঠিকানা বলার মতো অবস্থা নেই তখন। আদনান মল্লিক খান নামের একজন দিলেন তাড়া— ‘ভাই কই থাকেন বলেন তাড়াতাড়ি।’ এর মধ্যে একজন দিলেন ফিল্ড হাসপাতালে যোগাযোগের পরামর্শ, সাহায্যের আশায় আরেকজন ‘ম্যানশন’ করলেন কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীনকে। এমন সময়ে তানভির রনি নামের এজনের মন্তব্যের প্রতি উত্তরে ঠিকানা জানালেন আরেকজন, ওই রোগীর পরিবারেরই কেউ হবে হয়তো— ডি সি রোড মিয়ার বাপের মসজিদ…।

ঘন্টা পেরিয়ে যায়। পাহাড়তলী ও চকবাজার থেকে দুজন জানালেন, তাদের কাছে নেবুলাইজার মেশিন আছে। কিন্তু ঠিকানা খুঁজে এতো রাতে কে সেটা নিয়ে আসবেন? এতো রাতে গাড়ি কোত্থেকে মিলবে? শফিকুলের শ্বাসকষ্ট আরও বাড়তে থাকে। ঠিক এমন সময়ে হঠাৎ জ্বলে উঠলো আশার আলো। ঘন্টাখানেকের মাথায় তানভীর রনি নামের একজন মন্তব্যে জানালেন— ‘জাহেদুল ইসলাম শাকিল ভাই ভাই বের হয়েছেন। মেডিকেলের কাছাকাছি গেছেন, বাইক যেহেতু আছে আশা করি দ্রুত নেবুলাইজার কিনে উনার বাসায় দিয়ে আসবেন।’

ভালোবাসার অসংখ্য ইমোজিতে ভরে উঠলো সেই মন্তব্যের নিচটা। ফারজানা আফরোজ তখনই বললেন, ‘ধন্যবাদ এইভাবেই আপনারা এগিয়ে যান, ভালোবাসা অবিরাম ভালোবাসা রইলো।’ ওসমান গণি মন্তব্য করলেন, ‘২শ মানুষের অনর্থক সমাধানহীন বকবকানির পর কাজের কাজটিই করলেন। আল্লাহ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দিক।’

তানভীর রনির পরের আপডেট আসলো রাত ২টা ৩৩ মিনিটে— নেবুলাইজার মেশিন স্ট্যাটাস দেওয়া সেই রোগীর ‘বাসায় দিয়ে আসা হয়েছে।’

কিন্তু ততোক্ষণে ঘটে গেছে নাটকীয় ঘটনা। জাহেদুল ইসলাম শাকিল নামের ব্যক্তিটি তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে কোন্ সাইজের নেবুলাইজার কিনতে হবে তা জানতে শফিকুলের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারেন ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার আধা ঘন্টার মধ্যে রিদওয়ানুল হক নামে আরেকজন গিয়ে বাকলিয়া ডিসি রোডে শফিকুলের বাসায় নেবুলাইজার পৌঁছে দিয়েছেন।

৯৬ হাজার সদস্যের ‘করোনা আপডেট চিটাগং ওই গ্রুপটির এডমিন তানভীর রনি লিখেছেন— ‘পৃথিবীতে কিছু ভাল মানুষ বেঁচে আছে বিধায় করোনা আক্রান্ত মানুষরা এখনো টিকে থাকার স্বপ্ন দেখে। রাতের ১:৩০ এ কোভিড পজিটিভ শফিকুল ইসলাম ভাই গ্রুপে পোস্ট দেন তার অবস্থা বেশি খারাপ, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। একটা নেবুলাইজার এই মূহূর্তে খুব দরকার। রাতের দেড়টা বাজেও ১ ঘন্টায় গ্রুপের ২ শতাধিক মেম্বার উনাকে হেল্প করার জন্য এগিয়ে আসেন। আলহামদুলিল্লাহ। তাদের মধ্যে চাটগাঁইয়া রাইডার্সের জাহেদুল ইসলাম শাকিল পোস্ট দেখে কমেন্ট করেই বেরিয়ে পড়েন মেডিকেলের সামনে থেকে নেবুলাইজার কিনে আনার জন্য। মেডিকেলের সামনে গিয়ে আমাকে নক দেন কোন সাইজটা কিনবেন, বললাম ওয়েট উনাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি। ফোন দিতেই কোভিড আক্রান্ত শফিকুল ভাই বলেন এক অজানা ভাই কোন কমেন্ট করা ছাড়াই নেবুলাইজার নিয়ে চলে আসছে! খোঁজ নিয়ে জানলাম সেটাও চাটগাঁইয়া রাইডার্সের মোহাম্মদ রিদওয়ান ভাই।’

শনিবার রাত সাড়ে তিনটায় এই পোস্টের সূত্র ধরে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপ হয় করোনা আক্রান্ত রোগীর বাসায় নেবুলাইজার পৌঁছে দেওয়া রিদওয়ানুল হকের।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বললেন, ‘শফিকুল নামে একজন গ্রুপে পোষ্ট দিয়েছিলেন তিনি করোনা পজিটিভ। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার উনাকে নেবুলাইজার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। তার নেবুলাইজার দরকার। পোস্টটি দেখে সাথে সাথেই আমি উনাকে কল করি। আমি নিজে একজন বাইক রাইডার। জীবনে এত দ্রুততায় আমি কোথাও গিয়েছিলাম বলে আমার মনে পড়ে না। সবমিলিয়ে আমার বাসা থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল গিয়ে সেখান থেকে নেবুলাইজার সংগ্রহ করে রাত ২টা ৫ মিনিটে সেটা আমি উনার ছেলের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি।’

তিনি বলেন, ‘যার নেবুলাইজার লাগছিল উনার বাসা ডিসি রোডে। আমার বাসাও ডিসি রোড। তবে উনাকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না আমার। গ্রুপে উনার পোস্ট দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে উনার সাহায্যে এগিয়ে যাব। আমার বাসার পাশে হওয়াতে সেটা আমার জন্য সহজ হয়েছে। কিন্তু বাসা শহরের যেখানেই হতো না কেন আমি একইভাবে সেখানে যেতাম বলেই ঠিক করেছিলাম।’

রিদওয়ান বলেন, ‘আমি রাত ২টার দিকে উনার বাসার সামনে নেবুলাইজার নিয়ে যাই। উনার ছেলে এসে তা গ্রহণ করেন। যদিও আমরা যথেষ্ট দূরত্ব মেনেই এটা আদান-প্রদান করেছি। আমি একটা জায়গায় নেবুলাইজার রেখে সেটা উনাকে নিতে বলি। তিনি সেখান থেকে নেবুলাইজার সংগ্রহ করেন। একজন মানুষের এমন বিপদে পাশে দাঁড়াতে পেরে একটা প্রশান্তি কাজ করছে আমার মধ্যে।’

রিদুওয়ানুল হকের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার। তিনি চট্টগ্রাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে বিসমিল্লাহ ফার্মেসি নামে তার ভাইয়ের একটা প্রতিষ্ঠানেও সময় দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!