বড়শিতে এই প্রথম বঙ্গোপসাগরের টুনা মাছ ধরবে দেশের তিন জাহাজ

চট্টগ্রাম থেকেই জানা যাবে টুনা মাছ সমুদ্রের কত গভীরে আছে

লং লাইনার বড়শি দিয়ে গভীর সমুদ্র থেকে টুনা মাছ আহরণ করবে তিনটি জাহাজ। আর এই কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হবে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকেই। বঙ্গোপসাগরে এক লাখ ৩১ হাজার ৯৮ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকার (ইইজেড) নীল জলসম্পদের মালিক হয়েও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে গভীর সমুদ্র থেকে টুনা মাছ সংগ্রহ করতে পারছিল না বাংলাদেশ।

তবে মাছ শিকারের জন্য বিশেষ ধরনের এই তিনটি জাহাজ সমুদ্রে ভাসতে সময় লাগবে আরও ৭-৮ মাস। ‘ব্লু ইকোনমি’র অংশ হিসেবে ২৪ কোটি টাকায় চীন থেকে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান এ তিনটি জাহাজ সরবরাহ করবে।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে এসব তথ্য জানান মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক খ. মাহবুবুল হক।

গভীর সমুদ্রে এভাবেই ধরা হয় টুনা মাছ।
গভীর সমুদ্রে এভাবেই ধরা হয় টুনা মাছ।

মিয়ানমার ও ভারতের দখল থেকে মুক্ত হয়ে মোট এক লাখ ৩১ হাজার ৯৮ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা এখন বাংলাদেশের। নীল জলরাশির তেল, গ্যাস, মাছসহ প্রয়োজনীয় সম্পদ রক্ষা ও এর আহরণে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করার লক্ষ্যে সৎ ও দক্ষ জনবল গড়তে চায় সরকার। এর ধারাবাহিকতায় প্রথমেই গভীর সমুদ্র থেকে টুনা মাছ সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, লং লাইনার ভ্যাসেলের লম্বা সুতায় লাগানো থাকবে বড়শি। এ পদ্ধতিতেই গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ আহরণের জন্য তিনটি জাহাজ তৈরির কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে— যা শেষ হতে ৭-৮ মাস সময় লাগবে।

তিনি বলেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে টুনা মাছ সমুদ্রের কত গভীরে আছে তা জানা যাবে। সেভাবেই বড়শিযুক্ত সুতাকে কম গভীর থেকে অধিক গভীরে আবার অধিক গভীর থেকে কম গভীরে ওঠানামা করানো যাবে।

মাহবুবুল হক আরও বলেন, এ প্রকল্পে মাছ ধরার সব প্রযুক্তি ও অপারেশনাল জনবল সব বিদেশ থেকেই আনা হচ্ছে। যা বাংলাদেশে কাজ শুরু করবে দুই বছরের মধ্যে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের দেশের জনবল সৃষ্টি করা হবে। পরে আমাদের দেশের জনবল দিয়েই মাছ আহরণ করা হবে।

এছাড়া সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য পতেঙ্গায় একটি কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে— যার মাধ্যমে ‘রিয়েল টাইম মনিটরিং’ করা হবে। সমুদ্র থেকে আহরণ করা মাছের ৩০ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়, যা সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।

মাহবুবুল হক জানান, গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ ধরতে তিনটি লং লাইনার প্রকৃতির ফিশিং ভ্যাসেল সংগ্রহ, ভ্যাসেল পরিচালনায় দেশি-বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ, টুনা ও সমজাতীয় পেলজিক মৎস্য আহরণ, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার কর্মকৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা তৈরি, ক্রুসহ টুনা আহরণে নিয়োজিত ১০০ জনকে প্রশিক্ষণ এবং ৩৭ জন দেশীয় ও সাতজন আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগ কাজ চলমান রয়েছে।

এর আগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছিলেন, সাগরের টুনা মাছের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। দেশের বাজারেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সাগর থেকে আহরণের পর তা রফতানি করতে পারলে আমাদের এক্সপোর্ট বাস্কেট ও ভলিয়্যুম সমৃদ্ধ হবে। বঙ্গোপসাগরের টুনা ও সমজাতীয় মাছ আহরণের যেমন অভিজ্ঞতা আমাদের নাই, তেমনি দক্ষ জনবলও নাই। এসব কারণেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। আশা করছি ইলিশের সঙ্গে টুনা হবে আমাদের সম্পদ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক ড. এম শাহ নেওয়াজ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মোট মৎস্য আমিষের ১৫ ভাগ সামুদ্রিক মাছ থেকে আসে। জিডিপিতে এ খাতের অবদান ৩.৫%। এই অর্থনীতির সুফল পেতে সরকারিভাবে বিভিন্ন গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। তবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং একটি বিশেষ মেরিন প্ল্যান প্রণয়ন করলে দেশ এর সুফল পাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বঙ্গোপসাগরে এক লাখ ৩১ হাজার ৯৮ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকার (ইইজেড) এই নীল জলসম্পদের মালিক হয়েও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে গভীর সমুদ্র থেকে টুনা মাছ সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। এ কারণে গত বছরের ১৮ আগস্ট একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয় ‘গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ ও সমজাতীয় পেলজিক মাছ আহরণ’ প্রকল্প। পরীক্ষামূলকভাবে নেওয়া এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১ কোটি ছয় লাখ টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে তিনটি জাহাজ কেনার কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

বর্তমানে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। গভীর সমুদ্র থেকে টুনা মাছ আহরণ করলে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ওপরে উঠে যাবে। দেশে বর্তমানে উৎপাদিত মাছের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৭৭ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ মাছ মোট ৩৬ দশমিক ২২ লাখ মেট্রিক টন ও উপকূলীয় সামুদ্রিক মাছ ৬ দশমিক ৫৫ লাখ মেট্রিক টন।

টুনা মাছ যেন ওষুধের ফ্যাক্টরি

শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড মেলে এই চর্বিহীন মাছ থেকে। ওমেগা-থ্রি চোখ ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখার পাশাপাশি সারা দিনের শক্তি যোগাতেও সহায়তা করে। এছাড়া ওমেগা-থ্রি’য়ের আছে ‘আইকোসানোয়েডস’ যৌগ হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ও ‘এন্ডোক্রাইন’য়ের কার্যকারিতায় ভালো প্রভাব রাখে। ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরে উৎপাদিত হয় না। শরীরের বিভিন্ন কাজের জন্য দরকারী এই চর্বি নানান রকম খাবার যেমন— টুনা মাছ, সবজির তেল, বাদাম, তিসির বীজ ও তেল এবং শাক থেকে পাওয়া যায়।

টুনা মাছে থাকা ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এবং ওমেগা -৩ ফ্যাটি এসিড ত্বককে প্রাকৃতিকভাবে আর্দ্র (ময়েশ্চারাইজ) করে এবং ত্বককে কোমল রাখে। টুনা মাছে আছে প্রচুর ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, ভিটামিন এ এবং সেলেনিয়াম, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। হাড়কে শক্ত রাখতে এবং হাড় ভাঙ্গা ও ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে টুনায় থাকা ভিটামিন বি বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই ডায়েট চার্টে টুনা রাখুন এবং এর ফলাফল দেখুন।

টুনায় থাকা লো ফ্যাট, লো ক্যালিরি এবং প্রোটিন ওজন কমাতে সহায়ক। টুনায় থাকা ওমেগা-৩ রক্তের ভারসাম্য ঠিক রাখে এবং কোলেস্টেরল কমায়। ফলে হার্ট যথাযথভাবে কাজ করতে পারে। টুনা মাছে থাকা পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওমেগা-৩ এবং পটাশিয়াম যৌথভাবে কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমকে সচল রেখে রক্তচাপ কমায় এবং হার্ট এটাকের ঝুঁকি কমায়। টুনায় থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট ক্যান্সার কোষের সাথে যুদ্ধ করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত টুনা খেলে তা কিডনি ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

টুনা মাছে রয়েছে খাদ্য উৎপাদনের বেশ কয়টি প্রয়োজনীয় উপাদান। যা মানুষের শরীরের জন্য খুবই দরকারি। টুনা মাছ থেকে যে ক্যালরি পাওয়া যায়, তা ক্ষতিকর চর্বিমুক্ত। টুনা মাছে পর্যাপ্ত আমিষ আছে।

এছাড়া টুনা মাছে উচ্চমাত্রায় আয়রন। এতে থাকা ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স লোহিত রক্ত কণিকা গঠন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও টুনা মাছ ইনফ্লামেটরি ডিজিজ যেমন— আর্থ্রাইটিস, বাতের মতো রোগ সারাতে সাহায্য করে।

টুনা মাছে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উপাদান যেমন— সেলেনিয়াম এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, টুনা মাছের এই উপাদান গুলো স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, এটি কিডনি ক্যান্সারের বিরূদ্ধে বেশ উপকারী।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!