বাসে থেতলে এক পা বিচ্ছিন্ন শিশু অগ্ররাজের—পচন আরেকটিতেও, সহযোগিতার আকুতি মায়ের

‘মা, আমাকে পা ফিরিয়ে দাও। আমি স্কুলে যাবো, ফুটবল খেলবো।’

প্রতিনিয়ত এভাবেই মায়ের কাছে মিনতি করছে নার্সারি পড়ুয়া ছোট্ট শিশু অগ্ররাজ শিকদার (৫)। গত ফেব্রুয়ারিতে স্কুল শেষে গেটে মায়ের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় একটি বেপরোয়া বাসের নিচে পিষ্ট হয় অগ্ররাজের ছোট্ট দেহ। ঘাতক বাসের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাওয়া অগ্ররাজের বাম পা কেটে ফেলা হয়। ভেঙে যাওয়া ডান পায়েও ধরেছে পচন। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে তার অসহায় পরিবার। তাই ছোট্ট অগ্ররাজকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সমাজের বিত্তবানদের প্রতি সহায়তার আবেদন জানান তার মা জয়ন্তী দে পূর্ণিমা।

চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টার দিকে মুহুর্তেই দুনিয়াটা যেন বদলে যায় বাঁশখালী সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের নার্সারির ছাত্র অগ্ররাজ শিকদারের। প্রতিদিন মা স্কুল ছুটির আগে এসে অগ্ররাজকে বাড়ি নিয়ে যান। তবে ওইদিন স্কুল পাঁচ মিনিট আগে ছুটি হওয়ায় মা তখনো এসে পৌঁছাননি। ছোট্ট অগ্ররাজ তখন মায়ের জন্য স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। এই সময় বাঁশখালী থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া এস আলম সার্ভিসের একটি বেপরোয়া বাস একটি অটোরিকশাকে ওভারটেক করতে গিয়ে বিপরীত পাশে স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অগ্ররাজকে ধাক্কা দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, বাসটি প্রথমে অগ্ররাজকে ধাক্কা দিলে সে কেবল মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এরপর গাড়িটি ব্যাকগিয়ার দিয়ে পেছনে এনে অগ্ররাজের ওপর উঠিয়ে দেওয়া হয়। এই সময় গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে যায় তার দুই পা। অগ্ররাজের রক্তে লাল হয়ে যায় চারপাশ। উপস্থিত জনতা বাসটি আটক করে।

তখনও এসবের কিছুই জানে না অগ্ররাজের মা জয়ন্তী দে পূর্ণিমা। অন্যান্য দিনের মতো তিনি ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। স্কুলের পাশে অবস্থিত নাপোড়া বাজারের পশ্চিম পাশেই অগ্ররাজদের বাড়ি। ইতোমধ্যে ছেলের স্কুলের প্রায় কাছাকাছি চলে যান পূর্ণিমা। আর ২ মিনিট পরই পৌঁছে যেতেন স্কুল গেটের সামনে। এই সময় হঠাৎ কল আসে তার মুঠোফোনে। অপরপ্রান্ত থেকে জানানো হয় অগ্ররাজ ব্যথা পেয়েছেন। ছুটে গিয়ে পূর্ণিমা দেখতে পান তার ছেলের রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। অগ্ররাজের শরীর থেঁতলে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হইয়ে যাওয়া মাংসপিণ্ড পড়ে আছে রাস্তায়।

অগ্ররাজের মা জয়ন্তী দে পূর্ণিমা বলেন, ‘প্রতিদিন আমার ছেলের স্কুল ছুটি হওয়ার আগেই আমি গেটে গিয়ে হাজির হই। সেইদিন নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগে স্কুল ছুটি হওয়ায় আমি যাওয়ার আগেই আমার ছেলে গেটে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলাম, হয়তো আর দুই মিনিটের মতো লাগতো। এমন সময় আমার মোবাইলে একটা কল আসে, রিসিভ করতেই বলা হলো আপনার ছেলে ব্যথা পেয়েছে। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি রাস্তায় অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে। আমার ছেলের রক্তে আশপাশ লাল হয়ে গেছে।’

গুরুতর আহত অগ্ররাজকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে বাঁশখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামের এভারকেয়ার হাসপাতালে। ব্যয়বহুল এই হাসপাতালে চারদিনের চিকিৎসায় প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচের পর অগ্ররাজকে নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর রয়েল হাসপাতালে। এখানে গত ২১ ফেব্রুয়ারি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলা হয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাওয়া অগ্ররাজের বাম পা। এছাড়া ভেঙে যাওয়া ডান পায়েও অস্ত্রোপচার করা হয়। এর মধ্যে আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় চিকিৎসা বাবদ প্রায় ১০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। টাকার অভাবে দ্রুত হাসপাতাল থেকে অগ্ররাজকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। মাসে দু’বার বাড়ি থেকে হাসপাতালে এনে চেকআপ করতে হচ্ছে। তবে বর্তমানে অগ্ররাজের অবশিষ্ট ডান পায়েও পচন ধরেছে। ফলে এই পাও হারানোর শঙ্কায় ভুগছে সে।

অগ্ররাজ শিকদার দুই ভাইয়ের মধ্য বড়। নার্সারির ছাত্র অগ্ররাজ প্রায় সময় তার মাকে বলতো সে বড় হয়ে পাইলট হবে, বিমান চালাবে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজীবন পঙ্গুত্ব বরণের পথে সে। তার বাবা ধার-দেনা করে কয়েক মাস আগে ভাগ্য ফেরাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন ওমানে। তবে বর্তমানে ছেলের এমন করুণ দশার পর থেকে সারাক্ষণ কান্নাকাটির মধ্যেই যাচ্ছে তার প্রবাস জীবন। ইতোমধ্যে ছেলের চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অর্থনৈতিকভাবে।

এমন পরিস্থিতিতে অগ্ররাজের পাশে দাঁড়াতে বিত্তবানদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে তার পরিবার। শিশু অগ্ররাজকে সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে বিকাশ নম্বর (পার্সনাল) ০১৮৪০৭৫০৩১৭ এই নম্বরে। এছাড়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর ০৫৪৯১০১৯০৯১৯, জয়ন্তী দে পূর্ণিমা, পূবালী ব্যাংক, কুলগাঁও শাখা (অক্সিজেন মোড়), চট্টগ্রাম—এই ঠিকানায়ও পাঠানো যাবে সহযোগিতা।

এদিকে এই দুর্ঘটনার পর এস আলম বাস সার্ভিসের পক্ষ থেকে অগ্ররাজের চিকিৎসার জন্য অর্থ দিয়ে সহযোগিতার কথা বলে হলেও এখনও পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ তুলেছেন জয়ন্তী দে পূর্ণিমা। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর বাঁশখালী থানায় এস আলম বাস সার্ভিসের পক্ষ থেকে আবেদ সাহেব বলেছিলেন ২০ হাজার, ৩০ হাজার, ৫০ হাজার টাকা করে আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু তারা এই পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি। এমনকি এখনও পর্যন্ত তারা আর যোগাযোগই করেনি। আমাদের এখন অনেক টাকা দরকার ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে।’

তিনি বলেন, ‘তাদের কারণে আজ আমার ছেলের এমন দশা। যদি তারা আমার ছেলের এমন পরিণতিতে সহযোগিতা না করে, তাহলে আমি আইনিভাবে লড়াই করবো।’

জেএন/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!