পূর্ব রেলের ৩০ স্পটে পাথর ছোঁড়ার মরণখেলা, চট্টগ্রামেই ১০

ট্রেন আসার আগে লাইনে কান পেতে শোনে শিশু-কিশোরের দল। ট্রেন আসছে বুঝতে পারলেই তারা তৈরি হয় পাথর ছোড়ার জন্য। কোনো উদ্যোগেই এই মরণখেলা বন্ধ করা যাচ্ছে না। পাথর ছোড়ার আতঙ্কে ট্রেনে এখন যাত্রীরা জানালার পাশে বসতেই ভয় পান। খেলার ছলে শিশু-কিশোররা যেমন এসব হামলার সঙ্গে জড়িত, তেমনি পাথর নিক্ষেপের পেছনে রয়েছে মাদক পাচারকারীদের কৌশলী তৎপরতাও।

চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চল রেললাইনে পাথর ছোঁড়ার ঘটনা বেশি ঘটে ৫ জেলায় এবং ঝুঁকিপূর্ণ ‘স্টোন থ্রোয়িং’ বা পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে ৩০টিরও বেশি স্পটে। সবমিলিয়ে সারা দেশে ২০ জেলার মধ্যে ৭০টি স্পটকে স্ট্রোন থ্রয়িং স্পট বা পাথর নিক্ষেপ স্পট হিসেবে শনাক্ত করেছে রেলওয়ে। করোনার মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ১১০টি। এসব ঘটনায় ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙেছে ১০৩টি এবং আহত হয়েছেন ২৯ জন।

চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার মরণখেলা

সুবর্ণ এক্সপ্রেসের ট্রেনটি ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম আসার পথে রওনা হয়। সন্ধ্যা ৬টায় কুমিল্লার গোমতি ব্রিজ পার হওয়ার সময় একদল দুর্বৃত্ত হঠাৎ করে ট্রেনটি লক্ষ্য করে ৩-৪টি পাথর নিক্ষেপ করে। এতে ট্রেনের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে দুই যাত্রীর হাতে আঘাত লাগে। এ ঘটনায় মোট ৪ যাত্রী আহত হন। তবে জানালার পাশে থাকা ২ যাত্রী বেশি আঘাত পান। গত বছরের ৭ জানুয়ারির এই ঘটনায় যাত্রী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও পাথর ছোড়ায় মৃত্যুর ঘটনাও আছে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী তূর্ণা নিশীথা ট্রেনেই। ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট ট্রেনটি সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী এলাকায় পৌঁছার পর বাইরে থেকে ছোড়া পাথরের আঘাতে চুয়েটের এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়।

করোনা পরিস্থিতিতে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলে পাথর ছোড়ার ঘটনা কমে যায়। তবে সম্প্রতি রেল চলাচল শুরু হওয়ার পর আবার শুরু হয়েছে পাথর ছোড়ার মরণখেলা। সর্বশেষ গত ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ভৈরব রেল স্টেশনের আউটার সিগন্যাল এলাকায় চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারলে জানালার কাচ ভেঙে ট্রেনের সহকারী চালক কাউসার আহমেদের দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া কয়েকটি পাথর যাত্রীদের কামরায় গিয়ে আঘাত হানে।

এভাবে চলন্ত ট্রেনে প্রায়ই ঘটছে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা। পাথর ছোঁড়ার ঘটনায় রেলযাত্রীদের আহত হওয়ার ঘটনাও বাড়ছে। ঘটছে এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সচেতনতা সৃষ্টি কিংবা কঠোর আইন প্রয়োগেও যেন বন্ধ হচ্ছে না চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার মরণখেলা।

পাথর ছোড়ার ঝুঁকিপূর্ণ যতো স্পট

রেল পূর্বাঞ্চলের চার জেলার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি স্থান হচ্ছে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ড-বাড়বকুণ্ড এলাকা, কুমিরা, পাহাড়তলী, কৈবল্যধাম, কসবার ইমামবাড়ি, ফেনীর ফাজিলপুর-কালীদহ এলাকা, নরসিংদী শহর, জিনারদী ও ঘোড়াশাল এলাকা।

অন্যদিকে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলার যে ১৫টি স্থানে বেশি পাথর মারা হয়, সেই এলাকাগুলো হচ্ছে চুয়াডাঙ্গা, নাটোরের আব্দুলপুর, সিরাজগঞ্জ জেলার শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন, সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম রেলওয়ে স্টেশন, পাবনার মুলাডুলি, পঞ্চগড় জেলা ও ঠাকুরগাঁও জেলার কিসমত-রুহিয়া, পাবনার ভাঙ্গুরা, বগুড়ার ভেলুরপাড়া, গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা, জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, সিরাজগঞ্জের সলপ রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, সিরাজগঞ্জের জামতৈল রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, পাবনা জেলার বড়ালব্রিজ রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, খুলনার ফুলতলা স্টেশন এলাকা।

কে কোন্ বগিতে মারবে— চলে প্রতিযোগিতাও

জানা গেছে, শিশু-কিশোরেরা ট্রেন আসার আগে লাইনে কান পেতে শোনে। এতে তারা বুঝতে পারে ট্রেন আসছে। শব্দের তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে তারা অনুমান করে নেয়, ট্রেন কতোটা কাছে বা দূরে। এর ওপর নির্ভর করে রেললাইন থেকে পাথর নিয়ে তারা প্রস্তুত থাকে। কে কোন্ বগিতে মারবে, কে কাচ ভাঙবে, কে ইঞ্জিনে মারবে— এসব প্রতিযোগিতাও হয় পাথর নিক্ষেপকারীদের মধ্যে। শিশু-কিশোররা এটাকে খেলা বলেই মনে করে। রেল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরেই নানা উদ্যোগ নিয়ে এ ধরনের শিশু-কিশোরদের বোঝানোর চেষ্টা করে আসছে যে, তাদের জন্য যেটা খেলা সেটি আরেকজনের মৃত্যুর কারণ।

নেপথ্যে চোরাকারবারিদের হাতও

রেলওয়ের নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিরা নেপথ্যে দায়ী। রেলপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কম থাকায় মাদকদ্রব্যসহ চোরাইপণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার বাহন হিসেবে ট্রেনকে ব্যবহার করা হয়। রেলওয়ের অসৎ কর্মকর্তাদের সহায়তায় ট্রেন স্টেশনে ঢোকার আগে বা স্টেশন থেকে বের হওয়ার পর ট্রেনের গতি কমিয়ে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ট্রেন থামিয়ে অবৈধ মালামাল নামানো হয়। এসব ক্ষেত্রে মাদক পাচারকারীরা নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করতে থাকে। কোনো কারণে যদি ট্রেন ওই স্থানে না থামে তবে তারা পাথর নিক্ষেপ করে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রেলপথের নির্জন স্থানগুলোতেই সাধারণ পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে বেশি। এ ধরনের নির্জন স্থানে সাধারণত ট্রেন থামানো হয় না। কারণ চলন্ত ট্রেন থামাতে থামাতেই কয়েক কিলোমিটার চলে যায়। এরই সুযোগ নেয় পাথর নিক্ষেপকারীরা।

শাস্তি আছে, প্রয়োগ নেই

ট্রেনে পাথর মারার অপরাধে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, এমনকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান আছে। পাথরের আঘাতে কারও মৃত্যু হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান। তবে পাথর মারার দায়ে এ পর্যন্ত যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের প্রায় সকলেই শিশু, টোকাই, ভবঘুরে কিংবা মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ। এ কারণে কাউকে সাজা দেওয়া যায়নি।

পূর্ব রেলের ৩০ স্পটে পাথর ছোঁড়ার মরণখেলা, চট্টগ্রামেই ১০ 1

চলছে সচেতনতামূলক প্রচারণা

এদিকে সোমবার (৪ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড রেলওয়ে স্টেশনে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ রোধে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর উদ্যোগে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হয়েছে। এই প্রচারণাকালে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ, সিগনালের তার কাটা থেকে বিরত থাকা এবং লেবেল ক্রসিং পারাপারে সতর্কভাবে চলাফেরায় জনসাধারণকে অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ করা হয়।

এ সময় উপস্থিত শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোর ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং স্থানীয় জনসাধারণকে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ, সিগনালের তার কাটা ও অসতর্কভাবে রেলপথ পারাপার থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!