টাইগারপাসে গাছ কাটতে অনড় সিডিএ, পরিবেশ রি-মডেলিংয়ের যুক্তি খাড়া

‘এতদিন আন্দোলনকারীরা কোথায় ছিলেন’— পিডির বিস্ময়

চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প নির্মাণের জন্য টাইগারপাসে শতবর্ষীসহ ৪৬টি গাছ কাটা থেকে পিছিয়ে আসেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সিডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, গাছ কাটা স্থগিত রাখার বিষয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কারণ র‍্যাম্প করতে হলে ৪৪টি গাছ কাটতেই হবে।

এর আগে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) ‘নাগরিক সমাজের’ সঙ্গে বৈঠকের উদ্ধৃতি দিয়ে সিডিএ গাছকাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওইসব সংবাদে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষকেও উদ্ধৃত করা হয়।

সিডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, গাছ না কাটার বিষয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশ ছাড়া এ বিষয়ে ফেসবুকে লেখালেখি নিজেদের ক্রেডিট নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। র‍্যাম্প করতে হলে সিআরবির ৪৪টি গাছ কাটতেই হবে।

মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, তারা কোন সূত্রে দিচ্ছেন জানি না। ইভেন কী দিচ্ছেন, সেটাও জানি না। তবে আমি শুধু এটা জানি, এমন কোনো সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি। যারা দিচ্ছে তাদের তো আর সিডিএ কোনো ধরনের অফিসিয়াল মন্তব্য দেয়নি। কাজ বন্ধ করার কোনো সিদ্ধান্তও এখনও নেওয়া হয়নি।’

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর এর উদ্বোধন করেন। এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত এর ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সাবেক মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নামকরণের সিদ্ধান্ত নেয় সিডিএ। মূল এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি ওঠা-নামার জন্য ১৫টি র‌্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে দুটি পড়ছে টাইগারপাস এলাকায়। এই দুটি র‌্যাম্পের মধ্যে টাইগারপাস থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত অংশটিতে গাড়ি ওঠার একটি র‌্যাম্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সিডিএ। এজন্য সিডিএ সেখানকার শতবর্ষীসহ ৪৬টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরিবেশ সচেতন নাগরিকরা এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন।

এর সূত্র ধরে মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) বিকেলে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের সঙ্গে দেখা করে আন্দোলনকারীদের একটি দল। যেখানে অন্যদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন, নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আইনজীবী ইব্রাহিম চৌধুরী বাবুল। আন্দোলনকারীদের এই প্রতিনিধি দল সিডিএ চেয়ারম্যানকে এই অংশে কোনো ধরনের র‍্যাম্প না করার অনুরোধ জানান। এমন অনুরোধের জবাবে সিডিএ চেয়ারম্যান জানান, ঈদের পর সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

‘আন্দোলনকারীরা এতদিন কোথায় ছিলেন?’
এদিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মঙ্গলবার ‘নাগরিক সমাজের’ সঙ্গে বৈঠকের উদ্ধৃতি দিয়ে সিডিএ গাছকাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকে জানান, আন্দোলনের মুখে সিডিএ গাছকাটা থেকে সরে আসার কথা জানিয়েছে।

কিন্তু সিডিএ বলছে ভিন্ন কথা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিআরবি এলাকার এই অংশে যে একটি র‍্যাম্প হবে, তা প্রকল্প গ্রহণের সময়ই নির্ধারণ করা হয়। ইভেন এই র‍্যাম্পটি যে হবে, সেই বিষয়ে একাধিকবার আমরা ভিডিও দেখিয়েছি। বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেছি। এমনকি এই বিষয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদও প্রচার করা হয়েছে। তখন কোনো আন্দোলনকারী কিছু জানালেন না। যখনই কাজ শুরু করেছি, তখন ওনারা আন্দোলন শুরু করলেন। তাহলে এতদিন ওনারা কোথায় ছিলেন?’

আগে কেন আন্দোলন করেননি— এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট কায়সার আলী চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এটা আমরা আগে জানতাম না। এর আগে যখন সিআরবিতে হাসপাতাল হওয়ার কথা হলো, তখনই সাধারণ মানুষ জানতে পারে। কিন্তু তারও বহু পূর্বে হাসপাতাল নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানগুলো চুক্তি-ডিজাইন সব করে ফেলেছিল, কিন্তু আমরা জানতাম না। আমরা যখনই জেনেছি তখনই প্রকৃতির স্বার্থে আন্দোলনে নেমেছি। এক্ষেত্রেও তেমন হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ওই র‍্যাম্প দিয়ে তো আর রিকশা, ঠেলাগাড়ি উঠবে না, ব্যক্তিগত গাড়িই চলবে। সুতরাং আমাদের যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে তারা একটু কষ্ট করে জিইসি বা লালখানবাজার ঘুরে ফ্লাইওভারে উঠবো। তাতে তেমন কোনো সমস্যাও হবে না, পরিবেশেরও ক্ষতি হবে না।’

গাছ কাটা হবে ৪৪টি
সিআরবির যে অংশে র‍্যাম্প নামবে সেখানে ৪৪টি গাছ কাটতে হবে। তবে বড় কোনো গাছের ক্ষতি হবে না। আর র‍্যাম্পটি হয়ে গেলে এর পাশে আরও বেশি সংখ্যক গাছ লাগানো হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থে পরিবেশকে রি-মডেলিং করতে হবে। যেমন ধরুন, লালখানবাজার থেকে টাইগারপাস অংশে কাজের স্বার্থে আমরা কিছু পাহাড় কেটেছি। কিন্তু এখন কি কেউ বুঝতে পারবে যে ওখানে পাহাড় কাটা হয়েছিল? আমরা যতটুকু পাহাড় কেটেছি সেটা এমনভাবে মেরামত করে দিয়েছি, যাতে ভবিষ্যতে এটার জন্য কোনো নাগরিক দুর্ভোগ না হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড় কাটার পর স্থানীয় কাউন্সিলর আমাকে ড্রেন করে দিতে বলেছেন, আমি দুই ধারে ড্রেন করে দিয়েছি।’

র‍্যাম্প না হলে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ সুফল থেকে বাদ পড়বেন দাবি করে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এই এলাকায় র‍্যাম্প না হলে এই প্রজেক্টের সুফল সবাই পাবে না। কেননা এখানে যদি র‍্যাম্প না হয় তবে যাতায়াতকারীদের লালখানবাজার বা জিইসি মোড় দিয়ে যেতে হবে। আর অত দূরে কেউ ঘুরে যাবে না। আমি মনে করি, এই প্রজেক্টের সুফল থেকে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ বাদ পড়বে। এখানে র‍্যাম্প করতে হলে গাছ কাটতেই হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!