জনগণের ক্ষমতায়নের অন্যতম হাতিয়ার তথ্য অধিকার আইন

সুজলা, সুফলা শস্যভরা ক্ষেত, পাহাড়-পর্বত, দক্ষিণের নীল সমুদ্র, সাত শতকে অধিক নদ-নদীবেষ্টিত আমাদের এই বাংলাদেশ। এদেশে বসবাস করে সাড়ে ১৬ কোটির অধিক জনগণ – যাদের মধ্যে রয়েছে বাঙালি হিন্দু,মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ ক্ষুদ্র নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠী। এই সাড়ে ১৬ কোটি অধিক জণগোষ্ঠীর সব অধিকার দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত। সংবিধানের ১ম ভাগের সপ্তম অনুচ্ছেদে রয়েছে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক এদেশের জনগণ। জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার আইন নিশ্চিত করা আবশ্যক। এই সংবিধানের ৩য় ভাগের মৌলিক অধিকারের ৩৯নং অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক এবং বাকস্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তাই জনগণের সবকিছুর জানার এবং অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ তার কষ্টার্জিত আয়ের অর্থ থেকে ভ্যাট ও আয়কর প্রদান করে যা থেকে সরকার প্রতিবছর বাজেট প্রণয়ন করে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অবাধ তথ্যপ্রবাহের ফলে জনগণকে মুহুর্তে সবকিছু জানতে পারে। ঠিক তেমনি সরকারি সেবাসমূহের তথ্য জানার অধিকারও রয়েছে দেশের জনগণের। একসময় সরকারি গোপনীয়তা আইন ১৯২৩ এর দোহায় দিয়ে সরকারী চাকরিজীবীরা জনগণের সম্মুখে তথ্য প্রকাশ গোপন রাখত। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনে ২৯শে মার্চ পাশ হয় তথ্য অধিকার আইন-২০০৯। ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভের পর ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল গেজেট প্রকাশিত হয়।

তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী ”তথ্য’’ অর্থে কোনো কর্তৃপক্ষের গঠন কাঠামো, কাঠামো ও দাপ্তরিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত যে কোন স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, লগবহি, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নমুনা, পত্র, প্রতিবেদন, প্রকল্প প্রস্তাব, হিসাব বিবরণী , আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিও , অংকিতচিত্র, ফিল্ম, ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্ততকৃত যে কোন ইনস্ট্রুমেন্ট,যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌতিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে অন্য যে কোন তথ্যবহ বস্তু বা উহাদের প্রতিলিপি, তবে দাপ্তরিক নোট সিট বা নেট সিটের প্রতিলিপি তথ্য হবে না। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী সকল দেশীয় কর্তৃপক্ষ, সরকারি এবং বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমুহকে তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সব কর্তৃপক্ষকে একজন তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা, বিকল্প কর্মকর্তা নিযুক্ত বাধ্যতামুলক করা হয়েছে।

দেশের জনগণ কোন কর্তৃপক্ষের নিকট নির্দিষ্ট ফরমে,সাদা কাগজে বা ইলেকট্রনিক মেইলের স্বীয় স্বাক্ষরযোগে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী কাঙ্খিত তথ্য চাইতে পারেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিকট। এই আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ২০ কার্যদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। যদি তথ্য প্রদানে তৃতীয় পক্ষে সংশ্লিষ্টা থাকে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য প্রদান করতে হবে। যদি কর্তৃপক্ষ তথ্য প্রদান করতে অপারগ হয়, তাহলে ১০ কার্যদিবসের অপারগতার কারণ উল্লেখ করে যিনি তথ্য চেয়েছেন তাকে নির্দিষ্ট ফরমে মাধ্যমে জানিয়ে দিতে হবে।

তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথ্য প্রদানে অপারগ হলে তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষ হিসেবে আপিল কর্তৃপক্ষ এবং সর্বশেষ কর্তৃপক্ষ হিসাবে তথ্য কমিশন গঠন করা হয়েছে।

কোন তথ্য গ্রহণকারী যদি মনে করেন কর্তৃপক্ষ এমন তথ্য দিয়েছেন যেখানে তথ্য গ্রহণ বা তথ্য প্রাপ্তিতে তিনি সন্তুষ্ট নন বলে মনে করেন সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে তার কাঙ্খিত তথ্য পাওয়ার জন্য তিনি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবেন। আপিল কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে তথ্য প্রদানে নির্দেশ প্রদান করবেন, যুক্তিযুক্ত না হলে তা খারিজ করে দিবেন। যদি তথ্য গ্রহণকারী আপিলের তথ্য পেয়ে সন্তুষ্ট না হন, সেক্ষেত্রে তথ্য কমিশনে ৩০ দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট ফরমেট প্রতিকার চেয়ে আপিল করতে পারবেন। তথ্য কমিশন অভিযোগ অনুসন্ধানপূর্বক ৪৫ দিনের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করবেন যা ৭৫ দিনের অধিক হবে না। অভিযোগ বিবেচনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দোষী প্রমাণ হলে কমিশন প্রতিদিনের জন্য ৫০ টাকা করে সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জরিমানা করতে পারবেন এবং অভিযোগ আরো গুরুতর হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিভাগীয় ব্যবস্থার সুপারিশ করবেন। কোন তথ্য কারো মুক্তি বা জীবন-মরণ সংক্রান্ত হলে তা ২৪ ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রদান করতে হবে।

তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী জনগণ কর্তৃপক্ষের নিকট সব তথ্য চাইতে পারলেও এই আইনের ধারা সাত অনুযায়ী কতিপয় তথ্য প্রকাশ বা প্রদান বাধ্যতামূলক নয়। এই সংশ্লিষ্ট তথ্যসমূহ বাংলাদেশের নিরাপত্তা,অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হতে পারে এইরূপ তথ্য, পররাষ্টনীতির কোন বিষয় যার দ্বারা বিদেশি রাষ্ট্রের অথবা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা বা আঞ্চলিক কোন জোট বা সংগঠনের সহিত বিদ্যমান সম্পর্ক ক্ষুণ্ন হইতে পারে এইরূপ তথ্য, কোন বিদেশি সরকারের নিকট হইতে প্রাপ্ত কোন গোপনীয় তথ্য, কোন তথ্য প্রকাশের ফলে কোন তৃতীয় পক্ষের বুদ্ধিবৃত্তির সম্পদের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হইতে পারে এইরূপ বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক অন্তর্নিহিত গোপনীয়তা বিষয়ক, কপিরাইট বা বুদ্ধিবুত্তিক সম্পদ সম্পর্কিত তথ্য, কোন তথ্য প্রকাশের ফলে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা সংস্থাকে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত করিতে পারে এইরূপ তথ্য, আয়কর শুল্ক,ভ্যাট ও তদারকি সংক্রান্ত কোন আগাম তথ্য, মুদ্রার বিনিময় ও সুদের হার পরিবর্তনজনিত কোন আগাম তথ্য, ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনা ও তদারকি সংক্রান্ত কোন আগাম তথ্য, কোন আগাম তথ্য প্রকাশের ফলে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বা অপরাধ বৃদ্ধি পেতে পারে এইরূপ তথ্য, কোন প্রকাশের ফলে জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বা বিচারধীন মামলার সুষ্ঠু বিচার কার্য ব্যাহত হতে পারে এইরূপ তথ্য, কোন তথ্য প্রকাশের ফলে কোন ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হতে পারে বা অপরাধ বৃদ্ধি পেতে পারে এইরূপ তথ্য, কোন তথ্য প্রকাশের ফলে কোন ব্যক্তির জীবন বা শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হতে পারে এইরূপ তথ্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় জন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক গোপনে প্রদত্ত কোন তথ্য, আদালতে বিচারাধীন কোন বিষয় এবং যা প্রকাশে আদালত বা ট্রাইব্যুনালের নিষেধাঞ্জা রয়েছে অথবা যার প্রকাশ আদালত অবমাননার শামিল এইরূপ তথ্য, তদন্তধীন কোন বিষয় যাহার প্রকাশ তদন্ত কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এইরূপ তথ্য, কোন অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়া এবং অপরাধীর গ্রেফতার ও শাস্তিকে প্রভাবিত করতে পারে এইরূপ তথ্য, আইন অনুসারে কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এইরূপ তথ্য, কৌশলগত ও বাণিজ্যিক কারণে গোপন রাখা বাঞ্ছনীয় এইরূপ কারিগরি বা বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ কোন তথ্য, জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিকারহানির কারণ হতে পারে এইরূপ তথ্য, কোন ব্যক্তির আইন দ্বারা সংরক্ষিত গোপনীয় তথ্য, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বা পরীক্ষা প্রদত্ত নম্বর সম্পর্কিত আগাম তথ্য, মন্ত্রিপরিষদ বা,ক্ষেত্রমত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপনীয় সার-সংক্ষেপসহ আনুষাঙ্গিক দলিলাদি এবং উক্তরূপ বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত কোন তথ্য।

সরকার ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন করলে তার সুফল দেশের জনগণ পাচ্ছে, বিশেষত তথ্য অধিকার আইনের বাস্তব রূপ হচ্ছে স্বপ্রণোদিত হয়ে সকল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ওয়েবসাইটে জাতীয় তথ্য বাতায়নের মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ করছে। প্রত্যেক সরকারি অফিসের দৃশ্যমান স্থানে সিটিজেন চার্টার স্থাপন করা হয়েছে যা জনগণের তথ্য প্রাপ্তিতে বা সহজে সেবা গ্রহণের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। জনগণ চাইলে কোন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে সহজে সেবা গ্রহণ করতে পারে।

পিআইডি ফিচার
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, পিআইডি, চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!