চট্টগ্রাম মেডিকেলে হেলায় পড়ে আছে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, কষ্টের শেষ নেই প্রসূতিদের

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের বারান্দায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাবে প্রতিদিনই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে চিকিৎসা নিতে আসা প্রসূতিদের। বেশি কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে সিজারিয়ানের জন্য আসা রোগীদের। যন্ত্রপাতি সংকটের কারণে সিজারের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতে হয় এসব রোগীদের। এতে অনেক সময় মায়ের পেটেই মারা যায় অনাগত সন্তান।

গাইনি ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শর্মিলা বড়ুয়াও যন্ত্রপাতি সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তার মতে, অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি চিকিৎসক ও নার্স সংকট দূর করা গেলে এই ওয়ার্ড থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষ বেশি সেবা পেত।

জানা যায়, ১৯৯৫ সালে ৩৩ এবং ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে চালু করা হয় প্রসূতি বিভাগ। ২৬ বছর আগে সংযোজন হওয়া ৯ কোটি টাকা ব্যয়ের দুটি অপারেশন টেবিলের মধ্যে একটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। সাত লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ের ছয়টি লেবার টেবিলের মধ্যে সচল রয়েছে মাত্র দুটি। ২২ লাখ টাকার দুটি অ্যানেসথেসিয়া মেশিনের একটি নষ্ট।

এদিকে ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দামের ১০টি এসি, সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার তিনটি ভায়াথোলজি মেশিন, তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকার তিনটি অপারেশন লাইট, সাড়ে সাত লাখ টাকার বাচ্চার শরীর উষ্ণ রাখার মেশিন, পৃথক ওয়াশিং অ্যান্ড অটো ক্লিনিক স্পেস, রোগীদের জন্য পৃথক গাউন ও ক্যাপ সব পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে।

২০১৯ সালে তৎকালীন উপ পরিচলক ডা. মো. আখতারুল ইসলাম আধুনিকায়ন করতে চেয়েছিলেন গাইনি বিভাগকে। যার ধারাবাহিকতায় তখন এই বিভাগে নতুন দুটি লেবার (প্রসব) কক্ষ এবং আরেকটি সিজিারিয়ান কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল।

গাইনি ওয়ার্ড আধুনিকায়নের সময় জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউএনএফপিএ প্রসব কক্ষের জন্য ২০টি শয্যা বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে জায়গা না থাকায় সবগুলো বেড বসানো সম্ভব হয়নি। সেগুলো বারান্দায় ফেলে রাখা হয় দীর্ঘদিন। সেসময় নতুন প্রসব ও অস্ত্রোপচার কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল গাইনি বিভাগের পূর্বদিকে। তখন অস্ত্রোপচার কক্ষে চারটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) টেবিল বসানো হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে দুটি টেবিল নষ্ট।

এর আগে ১৯৬০ সালে যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল যাত্রা শুরু করে তখন ষষ্ঠতলায় একটি মাত্র প্রসব কক্ষ ছিল। তখন সিজারের ব্যবস্থা ছিল না। তাই সিজার করতে হলে রোগীদের আনা হতো চতুর্থ তলায়।

জানা যায়, জরুরি বিভাগ থেকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তির পর রোগীকে পাঠানো হয় অবজারভেশন রুমে। দু’জন ইন্টার্ন চিকিৎসক তাদের দেখে পাঠিয়ে দেন লেবার রুমে। সেখানে থাকেন মেডিকেল অফিসার। স্বাভাবিক প্রসবের রোগীদের ডেলিভারির দায়িত্ব থাকে মিডওয়াইফারি নার্সদের ওপর। কিন্তু তাদের সঙ্গে সহায়তায় করেন ওয়ার্ডের আয়ারা। আর প্রসবপূর্ব রোগী এবং পেটের বাচ্চার অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিজারিয়ান রুমে। কিন্তু সেখানে অপারেশন টেবিল রয়েছে মাত্র দুটি। অপারেশন থিয়েটারের টেবিলের জন্য সংকটাপন্ন রোগীদের অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘক্ষণ।

অথচ চট্টগ্রাম মেডিকেল একটি রেফারেল হাসপাতাল। আর এই মেডিকেলের গাইনি ওয়ার্ডকে নির্ভরযোগ্য মনে করে বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রসবপূর্ব মায়েরা এখানে আসেন। বেশিরভাগ শারীরিকভাবে জটিল প্রসবপূর্ব রোগীরা অন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিক হয়ে এখানে রেফার্ড হয়ে আসেন। দীর্ঘসময় অপেক্ষার ফলে বাচ্চা পেটের মধ্যে পায়খানা খেয়ে ফেলে কিংবা উল্টো অবস্থান নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড ভেঙ্গে গর্ভবতী মায়ের অন্যান্য শারীরিক জটিলতাও দেখা দেয়। তখন সিজার করা ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু চিকিৎসা নিতে এসে তাদের পড়তে হয় নানা ভোগান্তিতে।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৩৩ নম্বর প্রসবপূর্ব ওয়ার্ডে শয্যার সংখ্যা ৪৮টি। অথচ এর বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে ১৪০ জনেরও বেশি প্রসূতি সেবা নিতে আসেন। অন্যদিকে প্রসবোত্তর ওয়ার্ডে শয্যা সংখ্যা ৬৪টি। সেখানে ১০০ জনেরও বেশি প্রসূতি ও তাদের নবজাতকদের থাকতে হয়।

গাইনি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গড়ে প্রায় ৮০ জন প্রসূতি বাচ্চা প্রসব করেন চট্টগ্রাম মেডিকেলে। এরমধ্যে ৩০ থেকে ৩৫টি বাচ্চা প্রসব হয় সিজারে। বাকিগুলো হয় নরমাল ডেলিভারিতে। চারটি ইউনিটে ভাগ হয়ে গাইনি ও প্রসূতি বিভাগে সেবা দেন চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞসহ প্রায় ৭০ জন চিকিৎসক তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করেন এখানে। এ বিভাগে সেবা চালু থাকে ২৪ ঘণ্টা।

তবে এই বিভাগে আরও চিকিৎসক দরকার বলে জানিয়েছেন ডা. শর্মিলা বড়ুয়া।

ডা. শর্মিলা বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গাইনি বিভাগে সবসময় অতিরিক্ত রোগী থাকে। অনেক সময় সাধারণ রোগী রেখে জটিল রোগীকে সিজার করতে হয়। এছাড়া একসঙ্গে একাধিক ডেলিভারি করাতে হয়। তাই বাড়তি ওটি টেবিল প্রয়োজন।’

চিকিৎসক সংকটের বিষয়ে ডা. শর্মিলা বড়ুয়া বলেন, ‘ওয়ার্ডে চারটি ইউনিটে সহকারী রেজিস্ট্রার ও ইনডোর মেডিকেল অফিসারের সংকট রয়েছে। মূলত তিনভাগের একভাগ লোকবল দিয়ে এ ওয়ার্ডের কার্যক্রম চলছে। মূলত এমডি শিক্ষার্থীরাই এ ওয়ার্ডের চিকিৎসা কার্যক্রম সচল রেখেছে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!