চট্টগ্রামে বয়সীরাই করোনায় মারা যাচ্ছে বেশি, তরুণরা কম

করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই আলাদা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে চট্টগ্রামবাসী। নিয়ম মানার প্রবণতা যেমন এ অঞ্চলে কম, তেমনি আক্রান্তের তুলনামূলক হারও অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে ঢাকার পরেই এখন চট্টগ্রামের অবস্থান। চট্টগ্রামে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৩ এপ্রিল। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে সে সংখ্যা এখন চার হাজার ছুঁই ছুঁই। তবে করোনায় মৃত্যুর দিকেও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই চট্টগ্রাম। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার বাড়ছে। যেখানে সারা দেশে মৃত্যুহার বেশি ৬০ বছর কম বয়সীদের। চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগেরই বয়স ৬০ বছরের বেশি। অন্যদিকে করোনায় নারীর তুলনায় পুরুষ আক্রান্তের হার বেশি। তেমনি মৃত্যুর দিক থেকেও পুরুষের মৃত্যু হচ্ছে বেশি। মারা যাওয়াদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই পুরুষ।

চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণের ৬৩ তম দিনে করোনায় আক্রান্ত (কোভিড-১৯) হয়ে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৮৯ জনের। মৃত ব্যক্তিদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মৃত্যুবরণ করা বেশিরভাগই পুরুষ এবং ৫১ থেকে ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের মৃত্যুহার বেশি।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস শনাক্তের প্রথম একমাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান মাত্র ছয় জন। তবে সেই চিত্র হঠাৎ বদলে গিয়ে পরবর্তী এক মাসে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছেন আরও ৮৩ জন। করোনায় মৃত ৮৯ জনের মধ্যে মহানগরীর ৭২ জন এবং বিভিন্ন উপজেলার ১৭ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ৬৫ জন এবং নারী ২৪ জন।

তবে পুরো দেশের চিত্র দেখতে গেলে দেখা যায়, প্রথম ১০০ মৃত্যুর ক্ষেত্রে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মৃত্যুহার ছিল ৫১ শতাংশ। সেটি এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশে। আর ৬০-এর কম বয়সীদের মৃত্যুহার ছিল ৪৯ শতাংশ, সেটি বেড়ে ৫৫ শতাংশ হয়েছে। অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ৬০ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার বেশি। কিন্তু এর ব্যতিক্রম চিত্র চট্টগ্রামে। তরুণদের চেয়ে উল্টো ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের মৃত্যুহার বেশি। করোনায় যে তরুণদের মৃত্যু হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। তবে সে সংখ্যাটা অনেক কম।

দেশে প্রথম করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। আর চট্টগ্রামে শনাক্ত হয় তারও প্রায় একমাস পর অর্থাৎ গত ৩ এপ্রিল। দেশে প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। চট্টগ্রামে করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় শনাক্তের ৬ দিন পর ৯ এপ্রিল। যদিও মৃত ব্যক্তির করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ পায় মৃত্যুর পর।

এদিকে চট্টগ্রামে বয়সভেদে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব নারী-পুরুষই বেশি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম রোগীও ষাটোর্ধ্ব বয়সী পুরুষ। এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন রোগীর মধ্যে ৩৫ জন ষাটোর্ধ্ব। ২৬ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী। ১৪ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী। ৮ জন ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী। সংখ্যায় কম হলেও শিশু ও তরুণদের মৃত্যুর ঘটনাও আছে। কমসংখ্যক মৃত্যু হয়েছে তরুণ বয়সীদের। ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে রয়েছে ২ জন। ১১ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে রয়েছে ৩ জন এবং সবচেয়ে কম বয়সী রয়েছে একজন তাও ছয় বছর বয়সী এক ছেলে শিশু।

চট্টগ্রামে মৃতদের দুই-তৃতীয়াংশই পুরুষ
সারা বিশ্বেই করোনায় নারীর চেয়ে পুরুষেরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে। চট্টগ্রামেও এর ব্যতিক্রম নয়। মৃতদের প্রায় ৭৩ শতাংশ পুরুষ ও ২৭ শতাংশ নারী। দেখা যাচ্ছে, বৃহস্পতিবার (৪ জুন) পর্যন্ত মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দুই-তৃতীয়াংশই পুরুষ।

পুরুষদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলছেন, নারীদের সুস্থ, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতার কারণে তারা ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্ত লড়াই করতে পারছে। আবার জিনগত আচরণ ও হরমোনের পার্থক্যও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হয়।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৫ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এরমধ্যে পুরুষ ৩০ জন এবং নারী ৫ জন। ২৬ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে ১৮ জন পুরুষ এবং ৮ জন নারী। যা মোট মৃত্যুর ৪৫ শতাংশের বয়স ৬০-এর বেশি। অন্যদিকে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের ১১ জন পুরুষ এবং ৩ জন নারী। মধ্যবয়সীদের মধ্যে আবার এ অনুপাত সমানে সমান। মৃত ৮ জনের চারজন পুরুষ এবং চারজন নারী। তরুণদের দুইজনের মধ্যে একজন পুরুষ এবং একজন নারী। ১১ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত তিনজনই নারী। অন্যদিকে সবচেয়ে কম বয়সী মৃত ব্যক্তি পুরুষ।

করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম বয়সী ব্যক্তিরা কেন বেশি সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি। তবে চট্টগ্রামে মৃত্যুর হারের ভিন্ন চিত্র প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা ও দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ আছে বরং তাঁদের ক্ষেত্রেই করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি। চট্টগ্রামে ষাটোর্ধ্ব এ ৩৫ জনের বেশিরভাগ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতার ভুগেছেন।

এ প্রসঙ্গে জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে করোনায় মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা কিন্তু কম। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। কারণ করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর মৃত্যুর ঝুঁকি তখনই বেড়ে যায়, যখন শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি রোগীরা অন্য জটিল সমস্যায় ভুগছেন। সাধারণত বয়স হলে মানুষের সাধারণ রোগের পাশাপাশি অন্যান্য জটিল রোগেও ভোগেন। সেক্ষেত্রে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা সারভাইব করে উঠতে হিমশিম খান। তবে ষাটোর্ধ্ব অনেকেই সুস্থ হয়েও বাড়ি ফিরেছেন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!