চট্টগ্রামে ব্যাটারি রিকশা চলছে অভিনব টোকেনে, টাকার ভাগ যায় পুলিশ ও নেতাদের পকেটে

চট্টগ্রামে টোকেন বাণিজ্যে চলছে অবৈধ ব্যাটারি রিকশা। নগরীর বিভিন্ন এলাকার মূল সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব গাড়ি। অবৈধ গাড়ি বন্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো টোকেন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে ট্রাফিক পুলিশও। আবার এসব গাড়ি নিয়ন্ত্রণে নেপথ্যে রয়েছেন রাজনৈতিক দলের কিছু কথিত নেতা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টোকেন থাকলে নির্বিঘ্নে চলতে পারে এসব অবৈধ রিকশা। তবে টোকেন না থাকলেই বিপদ। অভিযানের নামে টোকেন ছাড়া গাড়িগুলো ধরে নিয়ে যায় ট্রাফিক পুলিশ। পরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তবে পুলিশের দাবি, টাকা নেওয়া বিষয়টি সত্য নয়। আর এসব ব্যাটারি রিকশা আমদানির অনুমতি দেওয়ার কারণেই দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাচ্ছে না।

নগরীর চকবাজার, পশ্চিম বাকলিয়া, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, দুই নম্বর গেট, দেওয়ানবাজার, জামালখান, দিদার মার্কেট, বাকলিয়া এক্সেস রোড, সৈয়দ শাহ রোড, রাহাত্তারপুল, পূর্ব বাকলিয়া বলিরহাট এলাকায় টোকেন বাণিজ্যে চলছে অবৈধ ব্যাটারি রিকশা।

খোঁজ জানা গেছে, নগরীর চকবাজার-বাকলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় দুই শতাধিক ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে প্রতিদিন। স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুসারী ও কিছু রাজনৈতিক নেতা লাইনম্যানের মাধ্যমে এসব গাড়ি থেকে টোকেনপ্রতি প্রতিদিন আদায় করে ১০০ টাকা। এই টাকার ভাগ যায় পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) ও স্থানীয় থানায়।

চকবাজার ধনিয়ারপুল থেকে রাহাত্তারপুল লাইনের শতাধিক ব্যাটারি রিকশা নিয়ন্ত্রণ করেন মো. দেলোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তিনি লাইনম্যান ফয়সাল ও জুয়েলের ম্যাধমে প্রতি রিকশা থেকে টাকা আদায় করেন। টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয় টোকেন। এসব টোকেনে ‘ডি’ অক্ষরে দেওয়া বিশেষ চিহ্ন রয়েছে। বিশেষ চিহ্নের টোকেন থাকলে ছেড়ে দেয় ট্রাফিক পুলিশ, না থাকলে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রাফিক পুলিশবক্সে। পরে মোটা অংকের টাকায় ছাড়া হয় এসব অবৈধ গাড়ি।

পাঁচলাইশ এলাকার জসিম উদ্দিন নামের এক ব্যাটারি রিকশাচালক বলেন, ‘প্রতিদিন ৩০০ টাকা দিয়ে গাড়ি চালাই। টাকার বিনিময়ে একটি টোকেন দেওয়া হয়। ওই টোকেন দেখালে পুলিশ ছেড়ে দেয়।’

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন অলিগলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে বেপরোয়া গতিতে। এসব রিকশা চালকদের অধিকাংশ অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। চালকদের কেউ কেউ চালাকি করে প্রতিবন্ধী সাজতে রিকশায় রাখেন স্ট্রেচার।

জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও চার চাকার ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের খরচ হচ্ছে। সাধারণত একটি ইজিবাইক চালানোর জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৯০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে এক লাখ ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ১১০ মেগাওয়াট এবং মাসে ৩৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। কিন্তু ৮০ ভাগ গ্যারেজ মূল সংযোগ থেকে তার দিয়ে চুরি করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এসব ব্যাটারি রিচার্জ করায় সরকার প্রায় ২৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

যোগাযোগ করা হলে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (প্রশাসন দক্ষিণ) অনিল বিকাশ চাকমা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করছি। গতমাসেও ৬০০ অবৈধ গাড়ি আটক করছি। তবে টোকেন বাণিজ্যে ট্রাফিক পুলিশের সম্পৃক্ততার অভিযোগটি ভুয়া।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে উপ পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক দক্ষিণ) এনএম নাসিরুদ্দিন বলেন, ‘ব্যাটারি রিকশা বন্ধে সবসময় অভিযান চলছে। টাকা আদায় করার বিষয়টি সত্য নয়। প্রতিনিয়ত ব্যাটারি রিকশা আমদানি হচ্ছে। আমদানি বন্ধ না হলে ব্যাটারি রিকশাও স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’

২০১৪ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে ২০১৭ সালে এসব পরিবহন বন্ধে আরেক দফা নির্দেশনা আসে। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর অটোরিকশা বন্ধ ও আমদানি নিষিদ্ধ করেন সর্বোচ্চ আদালত।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!