চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতা ঠেকানো ছাড়াও কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে সব বাজারকে ‘পলিথিনমুক্ত’ করার সময়সীমা বেধে দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। ১৫ ফেব্রুয়ারি ছিল পলিথিনমুক্ত করার শেষ সময়সীমা। কঠোর ওই ঘোষণার পর পেরিয়ে ইতিমধ্যে পার হয়ে একমাস। চট্টগ্রামের সব বাজারেই পলিথিনের ব্যবহার উল্টো আরও বেড়েছে। খোদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যেসব বাজারের পরিচালনায় আছে, সেগুলোতেই পলিথিনের রীতিমতো ছড়াছড়ি।
সবমিলিয়ে মেয়র রেজাউলের ঘোষণা যে ‘কথার কথা’, সেটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে— এমন কথা বলছেন অনেকেই। তবে আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে নগরীকে পলিথিনমুক্ত করতে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাথে দফায় দফায় আলোচনা করে আসছের মেয়র রেজাউল।
সর্বশেষ রোববার (১৩ মার্চ) এক সভায় নগরীকে পলিথিনমুক্ত করতে ওলামায়ে কেরামদের সহযোগিতা চাইলেন মেয়র। ওই সভায় তিনি বলেন, পলিথিন ব্যবহার বন্ধে চসিক যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও শুক্রবারের নামাজের খুতবা পড়ার সময় পলিথিনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরলে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হবে।
এর আগে ২৬ জানুয়ারি নগরীর টাইগারপাসে অস্থায়ী নগর ভবনে বিভিন্ন বাজার কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মেয়র বলেছিলেন, ‘১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে নগরীর সমস্ত বাজারকে পলিথিন মুক্ত করা হবে। ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নগরীর বাজারগুলোতে এ বিষয়ে মাইকিং, পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার, লিফলেট বিলি করে প্রচার চালাবে বাজার কমিটি। ১০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে সিটি করপোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট বাজার পরিদর্শন করে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করবেন।’
১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বাজারে কোনো পলিথিন পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী জরিমানাসহ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন মেয়র।
তবে বাস্তবে পলিথিনমুক্ত করতে মেয়েরের নির্দেশনা পালনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। পলিথিনের ব্যবহার কমাতে চসিকের জনসচেতনতামূলক প্রচারণা কার্যক্রমও নামমাত্র।
যদিও নিয়মিত বিভিন্ন অভিযানে পলিথিন রাখার দায়ে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করে আসছে সিটি কর্পোরেশন। সর্বশেষ (২৪ ফেব্রুয়ারি) নির্দেশনা না মেনে দোকানে পলিথিন রাখায় রিয়াজউদ্দীন বাজারের ৬ ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছে চসিকের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে এই অভিযান নগরীকে পলিথিনমুক্ত করতে যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে পরিবেশবিদরা।
পরিবেশবিদরা বলছেন, পলিথিন কর্ণফুলী নদীর তলদেশে জমাট হয়ে আট ফুটের বেশি শক্ত স্তর তৈরি করেছে— যা কর্ণফুলী নদীতে ড্রেজিং করতে গিয়ে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরে কর্ণফুলী নাব্যতা হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হবে। কর্ণফুলীর নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে চট্টগ্রাম বন্দরও কার্যকারিতা হারাবে; আর তার ভয়াবহ পরিণামে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে পড়বে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নগরীর চকবাজার, বহদ্দারহাট, কাজীর দেউড়ি, আগ্রাবাদ, ২নং গেইট, অক্সিজেন, মুরাদপুর, পাহাড়তলী, আন্দরকিল্লা ও রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকার বিভিন্ন বাজারে পলিথিনের ব্যবহার চলছেই। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত কাঁচাবাজারগুলোতেও পলিথিন সরবরাহ করে আসছে বিক্রেতারা।
সিটি কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত চকবাজার কাঁচাবাজারের সামনে বড় ব্যানারে লেখা আছে ‘পলিথিনমুক্ত বাজার’। সেই ব্যানারের ঠিক নিচেই পলিথিনের ব্যাগে ব্যবসায়ীরা পণ্য তুলে দিচ্ছেন ক্রেতার হাতে।
রোববার (১৩ মার্চ) চকবাজার থেকে মাছ ও সবজি কিনে বাসায় ফিরছিলেন কলেজ ছাত্র আনিস। তার হাতে থাকা মাছ ও সবজি ছিল পলিথিনে মোড়ানো। শুধু আনিস নয় বাজারের ক্রেতাদের শতভাগই পলিথিন ব্যবহার করছেন।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছে, সহজলভ্য ও দামে কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা পলিথিন ব্যবহার করে আসছে। পলিথিন উৎপাদনের কারখানা বন্ধ না করে বাজারকে পলিথিনমুক্ত করা সম্ভব হবে না। পরিবেশবান্ধব টিস্যু ব্যাগগুলোর দাম বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ফলে পলিথিন ব্যাগে আগ্রহ বেশি দেখায়। দাম কমিয়ে টিস্যু ব্যাগগুলোর সরবরাহ বাড়ালে বাজার পলিথিনমুক্ত থাকবে বলে ধারণা তাদের।
এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে নগরীর কাজীর দেউড়ি, কর্ণফুলী মার্কেট ও চকবাজার কাঁচাবাজারকে পলিথিন মুক্ত ঘোষণা দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। সেখানেও পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে অবাধে।
বাংলাদেশে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ২০০২ সাল থেকে। কিন্তু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পলিথিন দেশের সর্বত্র ব্যবহার হচ্ছে নির্বিচারে।
আরএম/সিপি