চট্টগ্রামের ৩২ হাসপাতাল ও ল্যাব চলছে অনুমোদন ছাড়াই, কাজ দেয়নি ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’

পরিবেশ ছাড়পত্রের অনুমোদন ছাড়াই চট্টগ্রাম নগরীর ৩২টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের মতো স্পর্শকাতর ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এ ব্যাপারে অনেকটাই নির্বিকার চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ।

২০২০ সালের ১৯ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইসেন্স নবায়ন না করায় চট্টগ্রামের ৩৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল করে পরিবেশ অধিদফতর। এছাড়া আটটি বেসরকারি হাসপাতালের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও চায় প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে ছয়টি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে ছাড়পত্র পায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে। কিন্তু বাকিগুলো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দিয়ে তাদের কার্যক্রম আগের মতোই চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র পাওয়া ক্লিনিকগুলো হল— চান্দগাঁও থানাধীন মোহরা কামাল বাজার এলাকার ওয়েল প্যাথলজি সেন্টার, পাঁচলাইশের দি হেলথ হোম (প্রাঃ) লিমিটেড, বন্দর চট্টগ্রামের মডার্ন ডায়াগনস্টিক এন্ড রিসার্চ সেন্টার, আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের প্যানেসিয়া ক্লিনিক্যাল ল্যাব, মেহেদিবাগের হরমোন ও ডিএনএ সেন্টার, কেবি ফজলুল কাদের রোডের কর্ণফুলী ব্লাড ব্যাংক এন্ড থ্যালাসেমিয়া সেন্টার।

২০২০ সালের ১৯ আগস্ট পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের এক চিঠিতে জানানো হয়, এইসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হালনাগাদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইসেন্স না থাকায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ অনুযায়ী পরিবেশ ছাড়পত্র বাতিল করা হয়েছে।

ওই সময় পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল হওয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো হল— হালিশহরের অর্গান হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চাঁন্দগাওয়ে রয়েল প্যাথলজি সেন্টার, মেডিকেল স্কয়ার, খুলশীর সিইআইটিসি লেন্স প্রসেসিং ইউনিট, হামজারবাগের সিটি লাইফ ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স, আগ্রাবাদ ও বন্দর এলাকার সানওয়ে মেডিক্যাল সেন্টারের দুটি শাখা।

এই তালিকায় আরও রয়েছে মনসুরাবাদ, জামালখান এবং দেওয়ানহাটের সূর্যের হাসি নেটওয়ার্কের তিনটি শাখা, পাঁচলাইশ এলাকার দি হেলথ হোম, চকবাজারের উডল্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পাঁচলাইশ এলাকার চিটাগং কেমোথেরাপি সেল সেন্টার, উত্তর আগ্রাবাদের নিষ্কৃতি ক্লিনিক, আকবরশাহ এবং চাঁন্দগাও ইমেজ সূর্যের হাসি ক্লিনিক।

পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল হওয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে আরও রয়েছে আন্দরকিল্লা এলাকার মুন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নতুন বাজার এলাকার কিউম্যাক্স হেলথ কেয়ার, হালিশহরের মেডিকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বন্দর ফ্রি পোর্ট এলাকার মডার্ন ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, বাকলিয়া ও কুলগাঁও অক্সিজেন মোড়ের ব্র্যাক যক্ষ্মা নির্ণয় কেন্দ্র, পতেঙ্গার কাঠগড় ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার।

এই তালিকায় আরও রয়েছে হালিশহরের এমএন ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ঈদগাঁ এলাকার মেডিসেভ প্যাথলজি ল্যাব, জামালখানের ল্যাব ওয়ান হেলথ সার্ভিসেস, সদরঘাটের পালস ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি অ্যান্ড ডায়াগনসিস, কোতোয়ালি থানা এলাকার দি মেডিক্যাল ল্যাবরেটরি, আগ্রাবাদের মেডিসিন মেডিক্যাল সার্ভিসেস এবং প্যানাসিয়া ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি প্রপার্টিজ লিমিটেড।

এছাড়া নাম রয়েছে মেহেদীবাগের হরমোন ও ডিএনএ সেন্টার, কে বি ফজলুল কাদের রোড়ের কর্ণফুলী ব্লাড অ্যান্ড খেলা থ্যালাসেমিয়া সেন্টার, খুলশীর চট্টগ্রাম কিডনি ফাউন্ডেশন, নাসিরাবাদের বায়েজিদ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্রবর্তক মোড়ের বাংলাদেশ আই হসপিটাল লি., কালুরঘাটের হেলথ লাইন ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার মেডি মেক্স ডায়াগনস্টিক সেন্টারের।

একই সঙ্গে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছরের ২৩ আগস্ট ছিল বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার সমূহের লাইসেন্স নবায়নের শেষ দিন। এরপর কেটে গেছে প্রায় বছরখানেক।

জানা যায়, করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহের অনিয়মের লাগাম টানতে গত বছরের ৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদফতরের টাস্কফোর্সের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানসমূহের লাইসেন্স নবায়ন করা না হলে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলতে দেওয়া হবে না বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই সভায়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তও থেকে গেছে কাগজে কলমেই।

এদিকে অনুমোদিত নয় এমন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বেশ কয়েকটিতে যোগাযোগ করা হলে তারা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে বানোয়াট ও মিথ্যা বলে অভিহিত করেছে। নগরীর পতেঙ্গা কাঠগড় ডায়াগনস্টিক এন্ড রিসার্চ সেন্টার এখনও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে ছাড়পত্র নেয়নি। এ প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ম্যানেজার হুমায়ুন কবির উল্টো চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সাথে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটা মিসটেক হয়েছিল। আমাদের সব কাগজপত্রই ঠিক আছে। আর আমাদের এখানে এফসিপিএস ডাক্তার চেম্বার করেন।’

পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নুরুল্লাহ নুরী বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন না থাকায় চট্টগ্রামের ৩৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল করা হয়েছিল। এছাড়া চট্টগ্রামের আরও আটটি হাসপাতালের কাগজপত্র চাওয়া হয়। কিন্তু গত এক বছরে মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে ছাড়পত্র নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে। বাকিগুলোর খবর নেই। আসলে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয় না থাকলে বাকি ৩২টি প্রতিষ্ঠানের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব না।’

গত বছর করোনার প্রথম ধাক্কায় নানা অভিযোগ ওঠার পর চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ শুরু করে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ। করোনা পরিস্থিতির পর থেকে চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দেয়। তাই দুর্নীতিতে ভরা এই খাতে তদারকি বাড়াতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে গত কয়েক মাসে গঠিত হয় একাধিক কমিটি। এইসব কমিটির তদারকির মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে মনিটরিং শুরু করে। কিন্তু এটিও একসময় স্থবির হয়ে পড়ে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ ভিজিটে গিয়েছি টেকনিশিয়ানদের টেকনিক দেখতে। কারণ অনুমোদিত নয় এমন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রয়েছে দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাব। নন-টেকনিশিয়ান ব্যক্তিদের দিয়ে চালানো হচ্ছে টেকনিক্যাল কাজগুলো।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনার কথা ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের। কোনো হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কোনো রকম অনিয়ম ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছিল। কিন্তু করোনা ঝামেলায় তা করা সম্ভব হয়নি।’

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!