চট্টগ্রামের সেই প্রতিবন্ধীর দোকান খোলেইনি, পুলিশের দাবির সঙ্গে মিল নেই বাস্তবের

হুমকির মুখে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এখনও

কিশোরগ্যাংয়ের অত্যাচার ও থানার ওসির ‘হুমকি’র মুখে বন্ধ করে দেওয়া এক প্রতিবন্ধীর দোকান পুলিশ খুলে দিয়ে তার নিরাপত্তার ব্যাপারেও আশ্বাস দিয়েছে— বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স উইং গণমাধ্যমকে এমন কথা জানালেও চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকৃতপক্ষে ওই দোকানটি খোলাই হয়নি। কোনো পুলিশও ওই প্রতিবন্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। স্থানীয় থানার কেউও সেখানে যায়নি। বরং চাঁদাবাজ কিশোরগ্যাং ও হাটহাজারী থানা পুলিশের হুমকির মুখে সেই প্রতিবন্ধী তরুণ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এখনও।

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মোবাইল মেরামতের একটি দোকান চালান শারীরিক প্রতিবন্ধী এরশাদ। ওই দোকানের আয় দিয়েই চলে তার সংসার। সম্প্রতি একটি কিশোরগ্যাংকে চাঁদা না দেওয়ায় তার দোকানটি বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই প্রতিবন্ধী অভিযোগ করেন, হাটহাজারী মডেল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম ওই কিশোরগ্যাংয়ের পক্ষ নিয়ে উল্টো ওই প্রতিবন্ধীকেই ইয়াবার মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।

গত ২৩ জুলাই চট্টগ্রাম প্রতিদিনে ‘প্রতিবন্ধীকে ইয়াবার মামলায় ফাঁসানোর হুমকি ওসির, জামাই আদরে কিশোর গ্যাং’ শিরোনামে এ বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

এর মধ্যেই রোববার (২৫ জুলাই) পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি, মিডিয়া) মো. সোহেল রানা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘প্রতিবন্ধী তরুণের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার সৃষ্টি হলে এটি নজরে আসে বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স উইংয়ের। এরপরই সেখান থেকে বিষয়টি জানানো হয় চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার পুলিশকে। পরে রোববার (২৫ জুলাই) পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে এরশাদের বন্ধ দোকানটি চালু করে দিয়েছে।’

এআইজি সোহেল রানা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এরশাদ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও আপলোড করেন। ভিডিওতে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে এরশাদ জানান, তার কাছে চাঁদা চেয়ে না পেয়ে তার দোকানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে হাটহাজারীর একজন ব্যক্তি বিষয়টি বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স উইংকে জানান। ভিডিওটি পরে হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলামকে পাঠিয়ে তদন্ত করে এরশাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাটহাজারী থানা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।’

কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিবন্ধী এরশাদের বন্ধ দোকানটি প্রকৃতপক্ষে খোলাই হয়নি। এমনকি পুলিশও ওই প্রতিবন্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। স্থানীয় থানা তো নয়ই।

সোমবার (২৬ জুলাই) রাতে প্রতিবন্ধী এরশাদ নিজেই চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে ফোন করে জানান, পুলিশ এসে তার দোকান খুলে দিয়েছে বলে যে তথ্য প্রচার করা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে সেরকম কিছু ঘটেনি। চাঁদাবাজ কিশোরগ্যাংয়ের হুমকির মুখে

শারীরিক প্রতিবন্ধী এরশাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাটহাজারী মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান গাজী মো. আলী হাসান এবং স্থানীয় চৌকিদার আমাদের বাড়িতে এসে আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলে পুলিশের একটি ফোন নম্বর দিয়ে সেখানে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি টানা দুদিন ধরে ওই নম্বরে ফোন দিয়েও কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। হাটহাজারী থানা থেকেও কেউ আসেননি।’

তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিনিয়ত হুমকির মধ্যে রয়েছি। এরা এখনও হুমকি দিয়েই যাচ্ছে। সোমবারও চাঁদাবাজ কিশোরগ্যাংয়ের একজন আমার ভাইকে হুমকি দেয় এই বলে— কী করতে পেরেছিস? শুধু শুধু সময় ও টাকা নষ্ট হল। আইন আমাদের বালও ছিঁড়তে পারবে না।’

এর আগে ২৩ জুলাই চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষমতার অপব্যবহার ও মর্মন্তুদ ঘটনার বিবরণ জানান ভুক্তভোগী চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসিন্দা প্রতিবন্ধী মো. এরশাদ। সেই সঙ্গে জীবন বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ অভিযোগ করে বলেন, ‘হামলাকারী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রভাবশালী হওয়ায় হাটহাজারী থানা পুলিশ তাদের পক্ষ নিচ্ছে। ফলে বিচার না পেয়ে আমাকে গ্রামছাড়া হতে হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জাবেদ ঘটনা চাপা দিতে মানসিকভাবে অত্যাচার করছেন। এমনকি ফেসবুক লাইভে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের শিখিয়ে দেওয়া কথা বলতেও বাধ্য করা হয়েছে আমাকে।’

এছাড়া এ ঘটনার নেপথ্যে মোহাম্মদ আলী নামে এক স্থানীয় ‘সাংবাদিক’ও জড়িত বলে জানান এরশাদ।

জানা গেছে, হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড ওবাইদুল্লা নগর এলাকার বাসিন্দা মো. এরশাদ (২৭)। জন্মের পর থেকেই তার দুটি হাত নেই। ভিক্ষাবৃত্তিতে না গিয়ে মোবাইল মেকানিকের কাজ শিখে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারে হাল ধরেন তিনি। বাড়ির পাশে ‘মায়ের আশা’ নামে তার একটি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান রয়েছে।

১৯ জুন হামিদুল ইসলাম, হৃদয়, ফারুকসহ স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য তার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা এরশাদের দুটি ছাগল ‘বিরিয়ানি খাবে’ বলে নিয়ে যেতে চায়। এ সময় স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে বাধা দেন তিনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ২৩ জুন দলবল নিয়ে তার দোকানে এসে ভাঙচুর চালায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। সেই সঙ্গে প্রশাসনের সহায়তা নিলে এরশাদকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় তারা।

প্রাণ বাঁচাতে ৭ জুলাই পুলিশের কাছে যান এরশাদ। হামিদুল ইসলাম, হৃদয়, ফারুক, সাকিব, নাঈম, খাইরুল আমিন, নাজিম ও সাদ্দামকে অভিযুক্ত করে হাটহাজারী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন তিনি।

কিন্তু মামলার পরই শুরু হয় নতুন বিপত্তি। অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় হাটহাজারী থানার পুলিশ তাদের আটক না করে বরং ‘পক্ষ নিয়ে’ এরশাদকে চুপ থাকতে বলে। আর এই ঘটনাকে পাড়ার ‘ফুটবল খেলা সংক্রান্ত ঝামেলা’ বলে চালিয়ে দিতে চায়।

এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর ছাপা হলে ২১ জুলাই হাটহাজারী থানার ওসি মো. রফিকুল আলম ঘটনাস্থলে গিয়ে এরশাদকে ধমক দেন। এছাড়া তাকে দোকান খুলতে চাপ দেন। এমনকি দোকান না খুললে তাকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো এবং প্রতিবন্ধী ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেন তিনি। এ সময় এরশাদ আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললে তাকে চুপ থাকতে বলেন ওসি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!