শয্যার হাহাকার চট্টগ্রামের হাসপাতালে, আইসিইউর ‘ওয়েটিং লিস্ট’ ক্রমেই হচ্ছে লম্বা

শয্যার চেয়ে রোগী বেশি সবখানেই

‘অনেক সতর্ক থাকতাম, কিন্তু হয়ে গেছে। অক্সিজেন ছাড়া ৫ মিনিট টিকে থাকতে পারি না’— চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে বলছেন একজন করোনারোগী। তার ভাগ্য অনেক ভালো, তিনি একটি শয্যা পেয়েছেন হাসপাতালে। কিন্তু প্রতিদিন বহু রোগী ফের ঘরে ফিরে যাচ্ছে হাসপাতালে একটি সিটের অপেক্ষায় থেকে থেকে।

করোনাভাইরাসের থাবা এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলো পৌঁছে গেছে তাদের সক্ষমতার শেষ সীমায়। হাসপাতালের দুয়ারে করোনার রোগী নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েও আইসিইউ তো দূরের কথা, সাধারণ শয্যাও মিলছে না। এ কারণে কোনো কোনো হাসপাতাল এখন সুস্থতার কিছুটা লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত রোগী ছেড়ে দিচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ তুলনামূলক কম সক্ষমতার অন্তত ছয়টি হাসপাতালকে কমপক্ষে ৫০০ করোনারোগীর চিকিৎসার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছে। তবে পরিস্থিতি যেভাবে দ্রুত খারাপের দিকে এগোচ্ছে, তাতে হাসপাতালে রোগীদের জায়গা দেওয়া যাবে কিনা— তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। কয়েকটি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ বলছেন, আগের তুলনায় এখন রোগীদের অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে হাসপাতালগুলোর সামনে অপেক্ষা করছে এক কঠিন সময়।

এরই মধ্যে মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ও মৃত্যু— দুদিক থেকেই নতুন রেকর্ড গড়ল চট্টগ্রাম। এই প্রথমবারের মতো মাত্র ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রামে করোনা শনাক্ত হল ১ হাজার ৩১০ জনের শরীরে। অন্যদিকে একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘন্টায় মারা গেলেন ১৮ জন। এটিও চট্টগ্রামের জন্য নতুন রেকর্ড। এই ১৮ মৃত্যুর ১১ জনই উপজেলার— এটিও ভাবিয়ে তুলেছে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের। চট্টগ্রামে ঠিক এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার পৌঁছে গেছে প্রায় চূড়ায়— ৪০ শতাংশে।

চট্টগ্রামে এখন নানামুখী তদবির করেও মিলছে না আইসিইউ শয্যা। কোনো কোনো হাসপাতালে সরকারিভাবে আইসিইউ শয্যা খালি আছে— এমনটি বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে চট্টগ্রামের সরকারি ও বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই সোমবার (২৬ জুলাই) রাত পর্যন্ত একটি আইসিইউ শয্যাও খালি ছিল না।

চট্টগ্রামের সরকারি ও বেসরকারি ১৩টি হাসপাতালের তিনটিতে কোনো শয্যা খালি নেই। অন্যদিকে বাকি হাসপাতালগুলোর তিন-চতুর্থাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি আছেন। অনেক হাসপাতালে জায়গার অভাবে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বারান্দায় রেখে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আবার সিট ফাঁকা হলে নতুন রোগী ভর্তির সময়ই বলে দেওয়া হচ্ছে, আইসিইউ শয্যা বা হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার দেওয়ার নিশ্চয়তা তারা দিতে পারবে না।

করোনারোগীর চাপ সামাল দিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ১০০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। কিন্তু সোমবার (২৬ জুলাই) পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ৩১৩ জন করোনারোগী। ১০ শয্যার আইসিইউ ও ১০ শয্যার এইচডিইউর কোথাও খালি নেই। অনেককে সেখানে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে মেঝেতে থেকে।

অন্যদিকে চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসার প্রধান বিশেষায়িত কেন্দ্র জেনারেল হাসপাতালে ১৫০ শয্যার বিপরীতে সোমবার (২৬ জুলাই) পর্যন্ত রোগী ভর্তি রয়েছেন ১৭০ জন। আইসোলেশন বেডে ১৩০টি শয্যা থাকলেও সেখানে রোগী ছিল ১৪২ জন। হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন ধরেই আইসিইউর একটি শয্যাও খালি থাকছে না। সেবার মান তুলনামূলক ভালো হওয়ায় প্রতিদিনই সেখানে করোনারোগীর ভিড় লেগেই আছে। শয্যা সংকটের পরও সবশেষ ২৪ ঘন্টায় সেখানে অতিরিক্ত রোগী করাতে হয়েছে অন্তত ৩০ জন। এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুরনো রোগীদের ১২ দিন পূর্ণ হলে এবং নতুন রোগীদের কারও ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেনের প্রয়োজন না হলেই ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

অন্যদিকে আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য শয্যা রয়েছে ১৬২টি। সোমবার (২৬ জুলাই) পর্যন্ত সেখানে রোগী ভর্তি ছিল ১৭০ জন। ২০ শয্যার আইসিইউ ও ১২ শয্যার এইচডিইউর একটি শয্যাও খালি নেই।

এদিকে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে পার্কভিউ হাসপাতাল, ইমপেরিয়াল হাসপাতাল, ম্যাক্স হাসপাতাল, ডেল্টা হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল, মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার, এশিয়ান স্পেশালাইজড হাসপাতালেও ‘ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই’ অবস্থা রোগীর চাপে। করোনারোগীদের চাপ সামাল দিতে চট্টগ্রাম নগরীর পার্কভিউ হাসপাতাল করোনার বিশেষায়িত দুটি ফ্লোরের পাশাপাশি আরও একটি নতুন ফ্লোর চালু করেও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালটির দুটি ফ্লোরে ৫২টি কেবিনে করোনারোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল এতোদিন। ঈদুল আজহার পর নতুন করে কেবিন বাড়ানো হয়েছে আরও ২৬টি। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিনই গড়ে ১৫ জন রোগী ভর্তির জন্য যোগাযোগ করছেন। একই সংখ্যক রোগী আইসিইউর একটি শয্যার জন্য ধর্না দিচ্ছেন। কিন্তু কেবিন ছাড়াও হাসপাতালটির ১২টি আইসিইউ শয্যা ছাড়াও এইচডিইউর সবগুলোর শয্যা সবসময়ই থাকছে পূর্ণ।

চট্টগ্রাম নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে কেবিন রয়েছে ৬৭টি। এর বিপরীতে সেখানে বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছেন ৭০ জন। তার মধ্যে ১০ জন রোগী আইসিইউতে। প্রতিদিন অন্তত ১০ জন রোগী সিট চেয়ে সেখানে যোগাযোগ করছেন।

এদিকে চট্টগ্রামের ছয়টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে এক সপ্তাহের মধ্যে করোনা চিকিৎসা দেওয়ার উপযোগী ব্যবস্থা বাড়িয়ে নেওয়ার নির্দেশ নিয়েছে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ। এই ছয় হাসপাতাল হচ্ছে— চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ইউএসটিসি হাসপাতাল। এই হাসপাতালগুলোতে চট্টগ্রামের অর্ধসহস্রাধিক করোনারোগীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটাও হয়তো সম্ভব হবে, কিন্তু চট্টগ্রামে মঙ্গলবারও (২৭ জুলাই) মাত্র ২৪ ঘন্টায় করোনারোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৩১০ জন— এই উর্ধগতিই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে দুশ্চিন্তার মূল কারণ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!