চট্টগ্রামের তৃণমূল নেতাদের ‘অহমিকা’ ভাবাচ্ছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে

সব নেতাই ‘জনপ্রিয়’ ভাবছেন নিজেদের

অন্য সব এলাকার মতো কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা সাম্প্রতিক সময়ে বৈঠক করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার নেতা ছাড়াও স্থানীয় সাংসদদের সঙ্গে। সম্মেলনের আয়োজন করে নতুন নেতৃত্ব আনাই ছিল মূলত এসব বৈঠকের মূল লক্ষ্য। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠক আয়োজনের আরও যেসব লক্ষ্য ছিল, তার মধ্যে রয়েছে দলের ভেতরের বিবাদ মেটানোর চেষ্টা। তৃণমূল আওয়ামী লীগে নেতায়-নেতায় শীতল লড়াইয়ের আঁচ মেলে প্রায়ই। অনেক এলাকায় এক নেতা হয়ে উঠেছেন আরেক নেতার চক্ষুশূল। এতে সাংগঠনিক গতি হারাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। এমন অবস্থায় দুশ্চিন্তায় পড়ে বিবাদ নিরসনের চেষ্টাও ছিল বৈঠক আয়োজনের পেছনে।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নিয়মিত এই আয়োজনে করোনার কারণে সাময়িক বিরতি টানা হলেও তারা আগের বৈঠকগুলো থেকে পাওয়া ফলাফল পর্যালোচনা করছেন নিজেদের মধ্যে।

এই পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বৈঠকে অংশ নেওয়া ছোট-বড় সব নেতাই স্থানীয়ভাবে নিজেদের ‘বিপুল জনপ্রিয়’ বলে দাবি করছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য— সকলেরই অভিন্ন দাবি, দলে তারাই অপরিহার্য। তাদের বেশিরভাগই সাংগঠনিক অবস্থার প্রকৃত চিত্রের বদলে শুধু নিজেদেরই গুণগান গেয়ে গেছেন। তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের পর্যবেক্ষণে এমন সব দাবিকে নিতান্তই বাড়াবাড়ি ও অতিশয় উক্তি হিসেবে ধরা দিয়েছে।

গত জুনের শুরু থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলার নেতা ও সংসদ সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। গত ২ জুন চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলা এবং চট্টগ্রাম মহানগরের সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে ১৯, ২০ ও ২১ জুন চট্টগ্রামে এসেও মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

৮ জুন রাজধানীর ধানমণ্ডিতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার নেতাদের নিয়ে বৈঠক হয়।
৮ জুন রাজধানীর ধানমণ্ডিতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার নেতাদের নিয়ে বৈঠক হয়।

এর মধ্যে ৮ জুন রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে চট্টগ্রামের তিনটি সংসদীয় আসনের উপজেলাগুলোর সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্যদের নিয়ে আলাদা তিনটি বৈঠক হয়। সকালে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা, বিকেলে পটিয়া উপজেলা এবং এরপর আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে বৈঠক হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন প্রমুখ।

ওই বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলো জানায়, বৈঠকে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা স্থানীয় সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন। তারা বলেন, সরকারের কোনো উন্নয়নমূলক কাজ কিংবা সংসদ সদস্যের কোনো অনুষ্ঠানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা আমন্ত্রণ পান না। সংসদ সদস্য নিজের মতো করে নিজস্ব লোকদের নিয়ে চলেন।

এসব অভিযোগের পাল্টায় সংসদ সদস্য নদভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত দেওয়া হয় না। আমাকে দলের কোনো কর্মসূচিতে ডাকা হয় না।’

ওই বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে সাংসদ নদভী বলেন, ‘জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে প্রয়োজনে ডামি নির্বাচন করুন। তখন দেখবেন আমি কত জনপ্রিয়! প্রয়োজনে ওই নির্বাচনের সব খরচ আমি দেবো।’

অন্যদিকে সাতকানিয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ মোতালেব নিজেকে ‘বিপুল জনপ্রিয়’ দাবি করে এমপি পদে মনোনয়ন চেয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচন করেছি। উপজেলা চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছি। ১২০টি কেন্দ্রের মধ্যে ১১৯টিতে পাস করেছি। আমাকে সাধারণ নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন দিলে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবো।’

কেন্দ্রীয় নেতারা উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে তাদের একসঙ্গে সমন্বয় করে কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দেন। উপস্থিত সংসদ সদস্য ও নেতারা ভবিষ্যতে সব কর্মসূচি সমন্বয় করে পালন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। আর কর্মসূচি নিয়ে কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে আলোচনার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

পরদিন ৯ জুন ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, চন্দনাইশ ও বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও সংসদ সদস্যদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকেও নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জড়িয়ে পড়েন।

সাতকানিয়ারই পাশের উপজেলা বাঁশখালী থেকে নির্বাচিত সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান এক্ষেত্রে এক কাঠি এগিয়ে নিজেকে ‘এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ’ হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘এই আসনে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে নির্বাচনে জিতবে এমন কেউ নেই।’

ওই বৈঠকে চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনের সাংসদ নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমার এলাকায় দলীয় কোনও দ্বন্দ্ব নেই।’

চন্দনাইশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তাদের দায়িত্বে আরও দীর্ঘদিন রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের হাতে নেতৃত্ব থাকলে এ উপজেলায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মোটেও থাকবে না।’

বক্তব্যের এই পর্যায়ে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জানতে চান, উপজেলার নেতারা সবগুলো ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের সম্মেলন করতে পেরেছেন কিনা। জবাবে কোনও সম্মেলন হয়নি— এমন উত্তর পেয়ে আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘তাহলে দায়িত্বে থেকে এদের মাধ্যমে সংগঠন কিভাবে উপকৃত হলো?’ সাংসদ নজরুল এ সময় জানান, তারা সম্মেলন করতে চাইলেও ওয়ার্ড-ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অনুরোধে করতে পারেননি।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা দলে নিজেদের বিশেষভাবে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভাবছেন। এই প্রবণতা দলের জন্য ক্ষতিকর। এই ভাবনা থেকে দল গোছানোর বদলে তারা অতিমাত্রায় অলস হয়ে পড়েছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে দলের মধ্যে তৈরি রাখছেন বিরোধ ও বিভাজন।

গত ২০ জুন চট্টগ্রাম জেলা সার্কিট হাউসে এক বৈঠকে এসে সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে গেলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। তিনি বলেন, ‘টানা ১২ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে আমাদের অনেকের মধ্যে একটা আয়েশি ভাব চলে এসেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা যতদিন আছেন, ততদিন তো ক্ষমতায় আছি। সংগঠন দুর্বল না সবল— সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এখন আমরা মনে করছি যে, সংগঠনের দিকে আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমরা অনেক জায়গায় দেখেছি যে, ১৫-২০ বছর ধরে সম্মেলন হচ্ছে না। একই কমিটির কোনো পরিবর্তন নেই। সাংগঠনিক কর্মপদ্ধতিও কার্যকর করা যাচ্ছে না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!