ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সাগরে ফেলে ৪ জেলেকে হত্যা, গ্রেফতার ৩

বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে চলতি বছরের ২০ মে নিখোঁজ হন লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতির বাসিন্দা নাসির মাঝিসহ ৪ জেলে। তাদের মাছ ধরার বোটটাও পাওয়া যায়নি।

শুরুর দিকে এটিকে জলদস্যুতার ঘটনা হিসেবেই ধরে নেন সকলে। এর মধ্যে নাছির মাঝির স্ত্রীর মোবাইলে মুক্তিপণের দাবিতে কলও আসে দফায় দফায়। আর সেই কলের সূত্র ধরে ৩ মাস পর জানা গেল চট্টগ্রামের এক আড়তদারের সাথে লেনদেনের দ্বন্দ্বের জের ধরে নাসির মাঝিকে বঙ্গোপসাগরে ফেলে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হওয়ায় বাকি ৩ জনের সাথেও ঘটে একই ঘটনা। আর পুরো ঘটনার জন্য নাসির মাঝির অধীনস্থ ৪ জন জেলের সাথে এক লাখ টাকার চুক্তি করেন চট্টগ্রামের নতুন ফিশারীঘাটের ইউসুফ সওদাগর নামের ওই আড়তদার।

এই ঘটনায় ইউসুফ মিয়াসহ হত্যায় জড়িত রাসেল ও আল আমিনকে গ্রেপ্তার করেছে রামগতির বড়খেরী নৌ-পুলিশ। হত্যায় জড়িত সুমন ও সোহাগ নামে আরও দুই আসামী পলাতক রয়েছে।

রামগতির বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চলতি বছরের মে মাসের ২০ তারিখ থেকে নাসির মাঝিসহ ৪ জন জেলে নিখোঁজ হয়। নিখোঁজ হওয়া বাকি ৩ জনের একজন নাসির মাঝির ছেলে মো. রিয়াজ। অন্য দুইজন হলেন নোয়াখালীর সুবর্নচর এলাকার আব্দুল মালেকের ছেলে মো. করিম এবং একই এলাকার আমির হোসেনের ছেলে মো. মিরাজ। এর মধ্যে মুক্তিপণ দাবি করে নাসিরের স্ত্রীর মোবাইলে কলও আসে। সেই কলের সূত্র ধরে আমরা তদন্ত শুরু করি। তদন্ত করে জানতে পারি মূলত চট্টগ্রামের ইউসুফ মিয়া নামে এক আড়তদারের সাথে লেনদেনের দ্বন্দ্বের জের ধরে নাসির মাঝিকে হত্যা করা হয়।’

ইউসুফ মিয়ার সাথে লেনদেনের দ্বন্দ্বের বিষয়ে পুলিশ পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘নাসির মাঝি ইউসুফ মিয়ার থেকে দাদন নিয়েছিল। তাকেই নাসির মাছ দিত। কিন্তু লকডাউনের সময় সে আরও আড়তদার থেকে দাদন নেয়। ফলে ইউসুফ মাঝিকে নিয়ম মত মাছ দিতে পারছিল না। এছাড়াও ইউসুফের রেফারেন্সে নাসির মাঝি বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা ধার নেয়। এসব পরিশোধ না করেই নাসির রামগতি চলে আসে। এ ঘটনায় ইউসুফ মিয়া ক্ষুদ্ধ হয়। সে ঠিক করে যেকোনো মূল্যেই নাসিরের বোট নিজের কব্জায় নেওয়ার। আর এজন্য নাসির মাঝির সহকারী রাসেল মাঝিকে এক লাখ টাকায় নিজের দলে ভেড়ায় ইউসুফ মিয়া।’

হত্যার ঘটনার বর্ননা দিয়ে কামরুজ্জামান আরও বলেন, ‘রাসেল মাঝি সুমন ও সোহাগ সহ বাকি ২ জনকে দলে ভেড়ায়। রাসেলের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৬ মে ওই চার জেলে রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডারের স্লুইসগেট বাজারের একটি ওষুধের দোকান থেকে ঘুমের ১০টি ট্যাবলেট কিনেন। পরদিন নাসির মাঝি ও অপর তিন জেলেসহ ওই চারজন মেঘনা নদীতে মাছ ধরতে যান। নদীতে মাছ কম ধরা পড়ার অজুহাত দেখিয়ে কৌশলে নাসির মাঝিকে হত্যাকারীরা কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এলাকায় সাগরে মাছ ধরার জন্য নিয়ে যান। হত্যাকারীরা ইউছুফের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলতি বছরের ২০ মে সেখানে তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী চায়ের সঙ্গে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে নাসির মাঝি, রিয়াজ, করিম ও মিরাজকে খেতে দেয়। চা খেয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়লে ওই চারজন মিলে তাদেরকে সাগরে ফেলে হত্যা করে। আর বোটটি তারা ইউসুফ মিয়াকে দিয়ে দেয়।’

পরে ওই বোটটিও চট্টগ্রাম মেরিন ফিশারিজ অফিসের অভিযানে আটক হয়। যদিও তারা সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার দায়ে বোটটি আটক করেছিল। ওই সময়ে তারা এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছুই জানতো না।

এই ঘটনার রহস্য উদঘাটনের বিষয়ে পুলিশ পরিদর্শক কামরুজ্জামান বলেন, ‘নাসির মাঝির স্ত্রীর মোবাইলে মুক্তিপণ দাবি করে একটা কল আসে। ওই কলটা করেছিল রাসেল মাঝি। মুক্তিপণের ওই কলকে সূত্র ধরে প্রযুক্তির ব্যবহার করে আমরা রাসেল মাঝিকে গ্রেপ্তার করি। সে সবকিছু স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে।’

রাসেলের দেওয়া তথ্যে চট্টগ্রামের আড়তদার ইউসুফ মিয়া ও রাসেলের সহকর্মী আল আমিনকে গ্রেপ্তার করেছে বড়খেরী নৌ পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরও দুইজন আসামী পলাতক রয়েছে। পলাতক দুই আসামী হলো সুমন ও সোহাগ।

এ ঘটনায় ১৩ জুন নাসির মাঝির স্ত্রী মীরজান বেগম বাদি হয়ে রাসেলের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত ২-৩ জনকে অভিযুক্ত করে রামগতি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এআরটি/এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!