ইস্টার্ন রিফাইনারিতে টেন্ডার হলেই লাভ বিস্ফোরক পরিদর্শকের, অভিযোগ গেল দুদকে

একই দফতরে টানা নয়বছর ধরে কর্মরত বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন। দীর্ঘদিন একই জায়গায় চাকরি করার সুবাধে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন এই কর্মকর্তা।

চট্টগ্রামের শতশত কোম্পানি ও কারখানার বিস্ফোরক লাইসেন্স দেওয়ার অনুমোদন, নবায়নের হালনাগাদ ও ফিটনেস সার্টিফিকেট সংক্রান্ত যাবতীয় নানা সমস্যা দেখিয়ে আদায় করছেন তিনি লাখ লাখ টাকা।

এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ নানা ইস্যু বানিয়ে আটকে দিচ্ছেন প্রতিবছর হালনাগাদের কাজ। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সরকারি তদন্ত সংস্থার বেশ কয়েকটি দপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে।

এদিকে অভিযোগ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগ দিয়েছে এই পর্যন্ত। এসব অভিযোগ মিথ্যা। যারা অভিযোগ দিয়েছেন, তাদের লাইসেন্স বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। এখানে আমার কি করার আছে।’

অভিযোগ সূত্রে বলা হয়, চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) বিস্ফোরক সর্ম্পকে কোনো দরপত্রের আহ্বান করা হলে সেখানে ঘুষ বাণিজ্যের ফাঁদ পাতেন পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন। ওই দরপত্রে কারা অংশ নিচ্ছে তার ডাটা নিয়ে একটি পক্ষের সঙ্গে আতাঁত করে কারিগরি সমস্যা দেখিয়ে বিস্ফোরক লাইসেন্স নবায়নের হালনাগাদ আটকে রাখেন তিনি। পরবর্তীতে দরপত্রের সময় সীমা পেরিয়ে গেলে আরও কিছু লেনদেনের মাধ্যমে কারিগরি ওই সমস্যা সমাধান হয় জানিয়ে হালনাগাদ করে দেন পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন।

সরকারি চাকরির বদলি সংক্রান্ত বিধানে বলা হয়, একজন কর্মকর্তা প্রতি স্টেশনে চাকরিকাল হবে তিন বছর (দূর্গম ও পাবর্ত্য অঞ্চলে দুই বছর)। ঢাকার বাইরে কোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি, বিদেশে প্রশিক্ষণ এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন—এই তিনটি কারণ ব্যতীত অন্য কোনো কারণে তিন বছরের আগে বদলি করতে হবে।

জানা যায়, ২০২১ সালের ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে ট্যাংক-সি বাণিজ্যিক একটি দরপত্রে অংশ নিয়েছিল মেসার্স শাহ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ার্স নামে একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ওই সময় দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ী প্রথম দরদাতা হিসেবে সদর উদ্দিন এন্ড সন্স ও দ্বিতীয় দরদাতা হলে দুই প্রতিষ্ঠানকে মালামাল নিতে সুযোগ দেয় ইআরএল কর্তৃপক্ষ। দরপত্রে দ্বিতীয় দরদাতা ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান যাতে মালামাল নিতে না পারে কৌশল করে আটকে দেয় বিস্ফোরক লাইসেন্সের নবায়ন। পরবর্তীতে দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ী সময় শেষ হলে ফিরিয়ে দেয় আটকে থাকা লাইসেন্স।

অভিযোগ বলা হয়, প্রতিপক্ষ ঠিকাদারের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা লেনদেনের করে মেসার্স শাহ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়াসের লাইসেন্স নবায়ন আটক রাখে পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন। এছাড়া মেসার্স শাহ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ার্সের লাইসেন্স নবায়ন আটক থাকা লাইসেন্সও সরকারি বিভিন্ন খরচ দেখিয়ে নিয়ম বর্হিভূত অতিরিক্ত টাকা নিয়ে শেষমেচ নবায়ন করে দিয়েছিল এই পরিদর্শক।

ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছেন, তফাজ্জল হোসেন ঘুষ লেনদেন করেন চাচাত ভাই জিলানীর মাধ্যমে। আগ্রাবাদ অফিসের পাশেই তার বাসা। সেখানে অবৈধ অর্থ লেনদেন করেন তিনি।

তবে এ বিষয়ে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমি কোনো অবৈধ লেনদেনের মধ্যে নেই। জিলানী নামে কাউকে চিনিও না।’

জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৮ জুলাই থেকে তিনি দুই দফায় পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বিস্ফোরক অদিধপ্তর চট্টগ্রামে। প্রায় ৯ বছর ধরে একই দপ্তরে আছেন তিনি।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৮ মার্চ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দুটি দরপত্র আহবান করে ইআরএল কর্তৃপক্ষ। ওই দরপত্রে ছিল ইস্টার্ণ রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) এর ফার্নেস অয়েল (এফও) স্টোরেজ ট্যাংক নম্বর ৬১১৯ পরিস্কার ও পেট্রোলিয়াম স্ল্যাব বিক্রয় কাজ, ইস্টার্ণ রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) এর রিডিউসড ক্রুড অয়েল (আরসিও) স্টোরেজ ট্যাংক নম্বর পরিস্কার এবং পেট্রোলিয়াম স্ল্যাব বিক্রয়।

দরপত্র ক্রয়ের শেষ সময় ছিল ২০২৩ সালের ২ এপ্রিল। দরপত্র জমা করার শেষ সময় ও খোলার তারিখ ছিল ২০২৩ সালের ৩ এপ্রিল। ওই দরপত্রে অংশ নেওয়া কয়েকজন ঠিকাদার অনিয়মের অভিযোগ তুললে বাতিল করে পুনরায় গত ৩০ মে আবারও দরপত্র আহ্বান করেছে ইআরএল।

চলমান এই দরপত্রে অংশ নেয় ভূক্তভোগী মেসার্স শাহ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানটিসহ আরও তিনজনের একটি ঠিকাদার সিন্ডিকেট। সেখানে ওই তিন ঠিকাদারের সিন্ডিকেটটি টেন্ডার পাইয়ে দিতে কারিগরি সমস্যা দেখিয়ে মেসার্স শাহ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ারের বিস্ফোরক লাইসেন্সটি বাতিল করে দেয় পরিদর্শত তোফাজ্জল হোসেন। যাতে দরপত্র খোলা হলে সেখানে বিস্ফোরক লাইসেন্সের কারণে ভূক্তভোগী প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেয়া হয়। অথচ বাতিল হওয়া লাইসেন্সটির মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৬ সালে অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর উপপরিচালক (ডিডি) মো. নাজমুচ্ছায়াদাত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‌‘আমার এখানে পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেনের তদন্তের ফাইল নেই। সম্ভবত এটি ঢাকায় কেউ করছেন।’

ভূক্তভোগী ঠিকাদার মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ২০১২ সালের ২৮ মার্চ থেকে একই স্থানে তেল সংরক্ষনের ডিপো দেখিয়ে লাইসেন্স নিয়েছে মেসার্স শাহ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ার্স। পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন একই দপ্তরে চাকরি করছেন প্রায় ৯ বছর ধরে। তিনি থাকা অবস্থায় ৬ থেকে ৭ বার লাইসেন্স নরবায়ন করেন তিনি নিজেই। অথচ সম্প্রতি একটি পক্ষের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করে আমাকে দরপত্র অংশ নেওয়া থেকে দুরে রাখতে শেষ পর্যন্ত মেসার্স শাহ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ার্সের লাইসেন্সটি বাতিল করে দেয় পরিদর্শক।

ভূক্তভোগী ঠিকাদার মো. নাসির উদ্দিন আরও জানায়, চলমান দরপত্র খোলা হলে হলে আমি সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে কাজটি পাবো। ওই দরপত্রে অংশ নেওয়া তিন সিন্ডিকেট দর দিয়েছে কয়েকগুণ কম। দরপত্রে খোলা হবে সেখানে আমি যাতে কাজটি না পায়, আবারও কৌশল করে হালনাগাদ থাকা অবস্থায় শেষ পর্যন্ত আমার লাইসন্সেটি বাতিল করে দিয়ে ইআরএলকে চিঠি দেয় বিস্ফোরক অধিদপ্তর।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!