আফগান স্পিন বিষে বিষণ্ন বাংলাদেশ

আফগানকে স্পিন দিয়ে শিকার বানানোর ফাঁদে ফেলতে গিয়ে নিজেরা স্পিন বিষে উল্টো শিকারে পরিণত হলো বাংলাদেশ। স্পিনিং উইকেট নিয়ে আফগানিস্তানকে স্বাগত জানাচ্ছে বাংলাদেশ এটি জানাজানি হওয়ার পর থেকে একটিই আশঙ্কা ছিল শিকারী হতে গিয়ে না শিকারে পরিণত হতে হয়। হয়েছেও তা। তাইজুল, মিরাজ, সাকিবরা যা করতে পারেনি তা করে দেখালো রশিদ, নবীরা।

টেস্ট মানে ধৈর্য। শুরুতে থিতু হওয়া। পরে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। ঝুঁকিপূর্ণ বল ছেড়ে দেয়া। বাজে বলে মারা। টুকটাক করে স্ট্রাইক বদল করা। জুটি গড়ে তোলা। অযথা ঝুঁকি না নেয়া। সাদা পোশাকের ক্রিকেট সম্পর্কে সামান্য খোঁজখবর রাখেন এমন যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে টেস্টের এই সরল গতিপথ হড়হড় করে জানিয়ে দেবেন!

ক্রিকেটারদের তো এই গোড়ার বিষয়গুলো বেশি করেই জানা। কিন্তু টেস্টের দ্বিতীয় দিনেই যখন প্রতিপক্ষের প্রথম ইনিংসের ৩৪২ রান মাথার ওপর পাহাড়সম বোঝা মনে হবে, তখন সরলঅঙ্কের সমীকরণে গড়ল ফলই মিলবে! বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও হল সেটাই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দিশেহারা ব্যাটিংয়ের একদিনে টেস্টের উত্তাপে পুড়েছে স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা।

আফগান স্পিন বিষে বিষণ্ন বাংলাদেশ 1
আফগানদের উজ্জ্বল চেহারাই বলছে কতটা বিষণ্ণ গেছে বাংলাদেশের দিন। ছবি: আজীম অনন

প্রতিপক্ষ ভালো বল করেছে। কেবল এটা মেনে নেয়ার মতো দিন যে ছিল না শুক্রবার। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বাজে আর দৃষ্টিকটু শট প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, প্রতিপক্ষ আফগানরা নেমেছে সবে তৃতীয় টেস্ট খেলতে। মনে করে দিচ্ছিল, এই টেস্টের পরে ভারত সফর দিয়ে পা রাখতে হবে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের উত্তপ্ত উনুনে। যেখানে পুড়লে দুবছর পর আছে অবনমনের সিলসিলাও।

দুদল মিলে ১৩ উইকেট পড়ার দিনে (আফগানদের ৫টি, বাংলাদেশের ৮টি) প্রথম সেশনে স্পিনঘূর্ণির পিচে আফগানিস্তান যখন অলআউট হতে হতে সাড়ে তিনশর কাছে পৌঁছাল, আশঙ্কার মেঘ তার আগে থেকেই ঘনত্ব বাড়াচ্ছিল বাংলাদেশের ব্যাটিং আকাশে। সেটা বেড়ে চাপের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে, একসময় টপাটপ উইকেট হারিয়ে পরিণত হয় মহাচাপে। স্বাগতিকরা যে ব্যাটিংয়ে শুরু থেকেই ধুঁকেছে। দলীয় সংগ্রহ যখন একশই ছোঁয়নি, সাজঘরে টপঅর্ডারের পাঁচ ব্যাটসম্যান।

দ্বিতীয় দিনে লাঞ্চের আগেই সফরকারীদের অলআউট করে বাংলাদেশ। ব্যাটিংয়ে এসে আবার কোনো রান যোগ করার আগেই হারায় নিজেদের প্রথম উইকেট। বাজে শটে ইনিংসের প্রথম ওভারেই ফেরেন সাদমান ইসলাম। ইয়ামিনের অফস্টাম্পের বাইরের বেরিয়ে যেতে থাকা ডেলিভারিতে খোঁচা দিয়ে ফেঁসে যান রানের খাতা খোলার আগেই!

লাঞ্চের পর দ্বিতীয় ওভারে নবির বলে লিটন দাসকে এলবিডব্লিউ দিয়েছিলেন আম্পায়ার। নাইজেল লংয়ের সেই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করেন লিটন। রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান। সৌম্য সরকারের সঙ্গে পরে জুটিতে ভালোই জমছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে দুজনেই ফিরে গেলে বিপদে পড়ে টাইগাররা।

প্রথমে ফেরেন সৌম্য সরকার। নবির জোরের উপর ছোঁড়া এক বল জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলতে গিয়ে লাইন গড়বড় করে এলবিডব্লিউ হন ৬৬ বলে ১৭ করে টেস্টের মতোই খেলতে থাকা সৌম্য। তখন ভেঙে যায় ৩৮ রানের সম্ভাবনার জুটিটিও।

আফগান স্পিন বিষে বিষণ্ন বাংলাদেশ 2
রশিদ খান ব্যাট হাতে ঝড়ো ফিফটির পর বোলিং আক্রমণে এসেই দেখা পান উইকেটের। দ্বিতীয় দিন শেষে তার ঝুলিতে চার উইকেট। ছবি: আজীম অনন।

কিছুপর নিজের সম্ভাবনার ইনিংসে অপঘাত পরিণতি ডেকে আনেন লিটন দাস। দৃষ্টিকটু শটে রশিদ খানকে দিয়ে আসেন উইকেট। আফগান অধিনায়কের প্রথম ওভার ছিল সেটি, তার লেংথ বলে পুল খেলতে গিয়ে লাইন মিস করে ডানহাতি ব্যাটসম্যান দেখেন স্টাম্প এলোমেলো। ৬৬ বলে ৩৩ রানের ইনিংসটি ততক্ষণে হিমঘরে।

সেখান থেকে মুমিনুল হক ও অধিনায়ক সাকিব আল হাসান লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেটাও দীর্ঘ হয়নি সাকিব রশিদের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরলে। ১১ রানে থাকা বাংলাদেশ অধিনায়ক রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি। লেগ-মিডলে পিচ করা বল যে তার ডিফেন্স এড়িয়ে সোজা গিয়ে স্টাম্পেই আঘাত হানছিল।

সাকিবের ফেরা যদি চাপ বাড়িয়ে থাকে। তার এক বল পর মুশফিকুর রহিমের আউট তৈরি করে মহাচাপ! মিডলঅর্ডারের ভরসা যে রানের খাতাই খুলতে পারেননি। রশিদেরই এক ডেলিভারি দেখেশুনেই ডিফেন্স করেছিলেন মুশি, বল তার ব্যাট ছুঁয়ে জুতোর মাথায় বাউন্স খেয়ে চলে যায় নিকটে ওঁত পেতে থাকা ইব্রাহিমের তালুতে। ভরসার পঞ্চম উইকেটের পতন!

বল টো, তথা জুতার অগ্রভাগে লেগে না মাটি ছুঁয়ে ক্যাচ হয়েছে সেটি নিশ্চিত হতে সফট সিগন্যাল আউট দিয়ে মাঠ আম্পায়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তলব করেছিলেন তৃতীয় আম্পায়ারকে। ক্যামেরার অনেক অ্যাঙ্গেল ঘুরিয়ে ফিরিয়েও সেখান থেকে আসে মাঠ আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত বহাল থাকার রসদ।

রশিদ তখন একের পর এক রশিদ-কেটে চলেছেন স্বাগতিক ব্যাটসম্যানদের সাজঘরে ফেরানোর। চা বিরতির পরও সেই ধারা থাকল। এবার শিকার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। অনেকটা শর্ট বল পেছনের পায়ে খেলতে যেয়ে প্রত্যাশিত বাউন্স পাননি অভিজ্ঞ এ ব্যাটসম্যান, ফলাফল- অফস্টাম্প হারাতে হয় কেবল ৭ রান করেই।

মুমিনুল হক তখনও জ্বলছিলেন। অনেকটা আক্রমণাত্মক ছিলেন এদিন। দারুণসব শটে ৬৯ বলে ৮ চারে ক্যারিয়ারের ১৩তম ফিফটি তুলে নেন। কিন্তু ইনিংস বড় করতে পারেননি। তাকেও তাড়া করে বাজে শটের ভূত! অতিরিক্ত শট খেলার মাশুল গুণে বাতাসে বল ভাসিয়ে মিডঅফে আসগরকে ক্যাচ দেন নবির বলে। থামে তার ৭১ বলে ৫২ রানের রঙিন পোশাকে খেলতে না পারার ঝাল মেটানোর ইনিংস!

পরের ব্যর্থতা মিরাজের। বলে জ্বলতে পারেননি, ব্যাটেও দিতে পারেননি ভরসা। এ অলরাউন্ডার ১১ রানে থামেন কাইসের বলে বোল্ড হয়ে। লেগস্টাম্পের বল সুইপ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ব্যাটে আসেনি, যেয়ে লাগে স্টাম্পে। আফগান লেগস্পিনারের যেটি অভিষেক টেস্ট উইকেট।

এরপরও স্বাগতিকরা যে অলআউট হল না এদিন, তাতে পুরো কীর্তিত্ব শেষঘণ্টা দারুণ জমিয়ে খেলা জুটি মোসাদ্দেক হোসেন ও তাইজুল ইসলামের। মোসাদ্দেক স্বীকৃত ব্যাটসম্যান, তারটা প্রত্যাশিতই। কিন্তু তাইজুল যেভাবে ব্যাট করলেন, তাতে মুখ লুকাতে পারেন টপঅর্ডারের অনেক ব্যাটসম্যানই।

মোসাদ্দেক-তাইজুল অবিচ্ছিন্ন ৪৮ রানের জুটি গড়ে, ১৪.৪ ওভারে। ৫৫ বল খেলে ১৪ রানে অপরাজিত আছেন বাঁহাতি এ স্পিনার, মোসাদ্দেক অপরাজিত ৪৪ রানে। তৃতীয় দিনে আরও কিছু রানের জন্য তাদের দিকে নিশ্চিতভাবেই তাকিয়ে থাকবে দল।

এদিন সকালে তাইজুল ও সাকিবের জোড়া সাফল্যের সঙ্গে মিরাজের এক উইকেটে আফগানিস্তানকে থামানো যায় সাড়ে তিনশর আগেই। সকালে শেষ পাঁচ উইকেটে আর ৭১ রান যোগ করতে পেরেছে সফরকারীরা। তাইজুল ৪টি, সাকিব-নাঈম নিয়েছেন ২টি করে উইকেট।

শুক্রবার খেলা শেষের খানিক আগে বৃষ্টি দোল দিয়ে গেছে। তাতে খুব বেশি সময় নষ্ট হয়নি। দুদলের একটা করে ইনিংস হাতে রেখে যে টেস্টে এখনও তিনদিন বাকি, সেখানে আপাতত সময়ের হিসাব কষা বোকামিই! হিসাব কষলে ফল টানতে হয় আফগানিস্তান যে প্রথম ইনিংস থেকেই একশর উপরে লিড নেয়ার চেষ্টায়, দ্বিতীয় ইনিংসে তার সাথে অল্পকিছুও যোগ করলে বাংলাদেশের জন্য দুঃস্বপ্নই অপেক্ষায় জহুর আহমেদের টুটা-ফাটা পিচে! রশিদ তো এই ইনিংসেই এখনও ৪ উইকেট নিয়েছেন। ২ উইকেট নেয়া নবি, কাইস-জাহিররা তাকে সঙ্গ দিতে তো প্রস্তুতই।
আফগানিস্তান: প্রথম ইনিংস-৩৪২/১০, বাংলাদেশ: প্রথম ইনিংস-১৯৪/৮ (৬৭) (দ্বিতীয় দিন শেষে)

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!