অক্সিজেন নিয়ে চট্টগ্রামে অমানুষের ব্যবসা, ৯ হাজারের সিলিন্ডার ২৭ হাজার টাকা

চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ৮ কিউবিক মিটারের একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ২৪ থেকে ২৭ হাজার টাকায়। তিন মাস আগেও এই অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া যেত আট থেকে ১০ হাজার টাকায়। সব বিক্রেতাই এখন একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা করে লাভ করছে। এমনকি সাধারণ একটি অক্সিমিটারেই লাভ করছে ৩ হাজার টাকা। এভাবেই চট্টগ্রামে গলাকাটা ব্যবসা চলছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিমিটার, নেবুলাইজারসহ প্রয়োজনীয় মেডিকেল পণ্য নিয়ে।

শুধু তাই নয়, তিন গুণ বেশি দামে সিলিন্ডার বিক্রির পর তারা ক্রেতাদের কোন রশিদও দিচ্ছে না। এমন অভিযোগ এসেছে কাতালগঞ্জ আনিকা কমিউনিটি সেন্টারের পাশে বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শহীদসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে। সদরঘাটের মেসার্স ব্রাদার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক দিলীপ কুমার নিজের ইচ্ছেমত দামে বিক্রি করছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিমিটার, নেবুলাইজারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। মেডিকেলের পূর্ব গেটের সাহান মেডিকোতে বিভিন্ন সাইজের অক্সিজেন সিলিন্ডার ও মিটার মিলিয়ে চার্জ করা হচ্ছে ২৫-৩০ হাজার টাকা।

বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজই শুধু নয়, চট্টগ্রামের অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই উঠেছে তিন থেকে চার গুণ দাম বেশি নেওয়ার অভিযোগ।

স্বাভাবিক সময়ে যে অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিল করতে লাগতো ৫০০ টাকা, তা এখন রিফিল করতে গুণতে হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। ১২০০ টাকার রেগুলেটর বিক্রি করছে তারা ৭ থেকে ৮ হাজার টাকায়। করোনার এ সময়ে শ্বাসকষ্ট রোগীদের এভাবেই ‘গলা কাটছে’ অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

অক্সিজেন নিয়ে চট্টগ্রামে অমানুষের ব্যবসা, ৯ হাজারের সিলিন্ডার ২৭ হাজার টাকা 1

অভিযুক্ত এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের পূর্ব গেটের জে কে এন্টারপ্রাইজ, বি কে ফার্মেসি, সাহান মেডিকোসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান।

পাঁচলাইশ থানার বাসিন্দা ছাত্রনেতা মেহেদী হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ বেশ কিছুদিন ধরে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকার সিলিন্ডার ২৪ থেকে ২৭ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। এলাকাবাসী তাদের ওপর এটি নিয়ে ক্ষুব্ধ। রোববার আমি ওই দোকানে যাই। গিয়ে দেখি ওরা রেগুলেটরের দাম নিচ্ছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। যার বাজার মূল্য ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানে যারা অক্সিজেন রিফিল করতে যায় তাদের বলা হয় রিফিল নাই। পরে বাধ্য হয়ে লোকজনকে সিলিন্ডার কিনতে হয়। আমি যখন বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমাকে দোকানদার বললেন, তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। তখন আমি তাদের বাড়তি দামের কাগজপত্র দেখাতে বলি। কিন্তু তারা কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। পরে বলে, আমার ইমপোর্ট বিল বেশি পড়ে। যখন বললাম এখন তো ইমপোর্ট সম্ভব না। এরপর উনি আমাকে কোন সদুত্তর না দিয়ে দোকান বন্ধ করে চলে যান।’

মেহেদী হাসান আরও বলেন, ‘এই দোকানের মালিক মো. শহীদ বাড়তি দামে সিলিন্ডার বিক্রি করেই ক্ষান্ত নয়। তিনি তার কাতালগঞ্জের বাসায়ও সিলিন্ডার মজুদ করেছেন বলে জানতে পেরেছি।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী মো. শহীদ ব্যস্ত আছেন জানিয়ে মোবাইল সংযোগ কেটে দেন।

অক্সিজেন নিয়ে চট্টগ্রামে অমানুষের ব্যবসা, ৯ হাজারের সিলিন্ডার ২৭ হাজার টাকা 2

এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পূর্ব গেটের জে কে এন্টারপ্রাইজের মোহাম্মদ জামাল ও বি কে ফার্মেসির বিরুদ্ধেও অক্সিজেন রিফিলে অতিরিক্ত দাম নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিনই। এই দুই প্রতিষ্ঠান একটি খালি সিলিন্ডারে অক্সিজেন গ্যাস রিফিল করতে নিচ্ছে তিন হাজার টাকা। এজন্য তারা কোন রশিদও দিচ্ছে না গ্রাহককে।

তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তা অস্বীকার করে জে কে এন্টারপ্রাইজের মোহাম্মদ জামাল বলেন, ‘দাম বাড়ার পর থেকে গত ১৫ দিন আমরা কোন সিলিন্ডার বিক্রি করছি না। শুধুমাত্র রিফিল করি।’

অন্যদিকে সোমবার (৮ জুন) চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিরিন আক্তার ও মো. উমর ফারুকের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযান চলাকালে সদরঘাটের মেসার্স ব্রাদার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক দিলীপ কুমার কোন পণ্য কেনার কোন ইনভয়েস বা ব্যাবসায়িক কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। নিজের ইচ্ছেমত দামে তিনি বিক্রি করছিলেন অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিমিটার, নেবুলাইজারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম।

জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পূর্ব গেটের ফার্মেসিগুলোতে ২৫-৩০ হাজার টাকায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হতে দেখেছেন। বিক্রেতাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ভুয়া ইনভয়েসও।

চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা, সদরঘাট ও প্রবর্তক মোড়ে চালানো অভিযানে দেখা গেছে, আন্দরকিল্লার তাজ সার্জিক্যাল ও নিপা সার্জিক্যালে অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। বন্ধ ছিল আন্দরকিল্লার এবি সার্জিক্যাল ও প্রবর্তক মোড়ের কে কোবরা সার্জিক্যালও।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিরিন আক্তার জানান, মেডিকেলের পূর্ব গেটে সাহান মেডিকোতে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন সাইজের অক্সিজেন সিলিন্ডার ও মিটার মিলিয়ে চার্জ করা হচ্ছে ২৫-৩০ হাজার টাকা। ৬.০০ ঘনলিটারের একটি সিলিন্ডারে অক্সিজেন রিফিল খরচ ৩০-৩৫ টাকা হলেও নেওয়া হচ্ছে ৬০০-৭০০ টাকা।

রক্তে অক্সিজেন ও পালসের পরিমাণ নির্ণয় করার ছোট যন্ত্র অক্সিমিটারের দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। বেশি দামে অক্সিজেন ও অক্সিমিটার বিক্রির অভিযোগে মেডিকেলের পূর্ব গেটের সাহান মেডিকোকে ১ লাখ ও পাশের অন্য একটি ফার্মেসিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে সোমবার।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এই বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছি। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। এর পাশাপাশি জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে। তারা ভীত হয়ে ঘরে সিলিন্ডার মজুদ করছে। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। জনসাধারণ এটি পরিহার করলে তারা এই সুযোগ পাবে না।’

এমআইটি/সিএম/এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!