চট্টগ্রামেও শিশুদের স্বাস্থ্যে মোবাইলের হানা, দেরিতে কথা বলার সমস্যা বাড়ছেই

চট্টগ্রাম মেডিকেলে মাসে ৭০ শিশু যাচ্ছে একই সমস্যায়

নাভিদের বয়স ৬ বছর। কিন্তু এই বয়সেও সে কেন কথা বলে না— তার বাবা-মা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। সে খুবই অস্থির। একা থাকতে পছন্দ করে। কানে শোনে, কিন্তু নাম ধরে ডাকলে তাকায় না। আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে হাঁটে। সারাক্ষণ হাত নাড়ে। বাবা-মা এসব আচরণকে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি কখনোই। তবে বেশ কয়েক জায়গায় শুধু স্পিচথেরাপি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন কথা বলানোর জন্য।

শহরে বড় হওয়া এরকম আরও অনেক শিশুই দেরিতে কথা বলছে। ইদানিংকালে এটা পৌঁছে গেছে অস্বাভাবিক পর্যায়ে। চট্টগ্রাম শহরেও এরকম শিশুদের নিয়ে হরহামেশাই বাবা-মায়েরা যাচ্ছেন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে। কেবল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের শিশু বিকাশ কেন্দ্রেই প্রতি মাসে গড়ে ৭০ জন শিশু যাচ্ছে স্পিচ ডিলে বা দেরিতে কথা বলার সমস্যা নিয়ে।

এজন্য খেলার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকা ও পারিবারিক একাকিত্বসহ নানা বিষয়কে দায়ী মনে করা হচ্ছে। শিশুর দেরিতে কথা বলার বড় কারণ হিসেবে চট্টগ্রামের শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা দায়ী করছেন মোবাইলের ‘স্ক্রিন’ ব্যবহারকে।

শিশুদের খাওয়ানোর কাজটা সহজ করতে অনেক বাবা-মা মোবাইল, ট্যাব বা স্ক্রিনযুক্ত ডিভাইস বাচ্চাদের হাতে তুলে দেন। শিশুরা ওই ডিভাইসের স্ক্রিনে বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু এর পরিণতি যে মারাত্মক ক্ষতিকর, তা হয়তো তারা জানেনই না। ফলে শিশুদের দক্ষতার বিকাশে দেরিতে ঘটে। এর মধ্যে কথা বলতে এবং অন্যদের সাথে মেলামেশা শিখতে দেরি হয়।

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চার বয়স দেড় বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদেরকে স্ক্রিন ব্যবহার করতে দেওয়া ঠিক নয়। তবে এজন্যে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া খুব কঠিন বলেও মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই বছর বয়সী বাচ্চারা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৭ ঘণ্টা করে স্ক্রিনের সামনে কাটায়। কিন্তু তাদের বয়স যখন তিনে পৌঁছায় তখন তাদের স্ক্রিনটাইমও বেড়ে দাঁড়ায় সপ্তাহে ২৫ ঘণ্টা। আবার যখন পাঁচ বছর হয় তখন সেটা কমে হয় ১১ ঘণ্টা। সাধারণত শিশুরা এই সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। স্ক্রিনটাইম বেড়ে যাওয়ার কারণে শিশুদের বিকাশে যে দেরি হয়, সেটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। দেখা গেছে, ঠিক তখনই স্ক্রিনটাইম আরও বেড়ে গেছে।

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চারা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে যে সময়টা পার করছে, এই সময়ে তারা গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক কিছু শিখতে পারতো। এই সময়ে আরেকজনের সাথে কথা বলা ও শোনার দক্ষতা তৈরি হতে পারে। দৌড়ানো, কোন কিছু বেয়ে ওপরে ওঠার মতো শারীরিক দক্ষতাও সে অর্জন করতে পারতো।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু রোগ বিভাগের আওতাধীন হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ জন শিশু আসে স্পিচ ডিলে বা দেরিতে কথা বলার সমস্যা নিয়ে।

এ বিভাগের চাইল্ড ফিজিশিয়ান ও ইনচার্জ প্রমুগ্ধা হাফিজ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, এখন শিশু বিকাশ কেন্দ্রে আসা শিশুদের সমস্যা থাকে স্পিস ডিলে নিয়েই। মাসে ৬০ থেকে ৭০ জন শিশু আমরা পাই, যারা দেরিতে কথা বলছে। কিংবা নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা পর্যাপ্ত বাক্য গঠন করতে পারছে না। যে সময় একটা শিশু বাবা-মা, ভাইবোন, দাদা-দাদীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে বাক্যালাপ করে কথা আয়ত্ত্ব করার কথা, সেই সময়টাই সে বড় হচ্ছে একাকী। কর্মজীবী মায়ের বাচ্চা বড় হচ্ছে কাজের লোকের কাছে কিংবা ডিভাইস নিয়ে। শুধুমাত্র যোগাযোগ না হওয়ার জন্য তাদের মুখের ভাষা তৈরি করতে পারছে না।

এজন্য পারিবারিক বন্ধনের ওপর জোর দিয়ে প্রমুগ্ধা হাফিজ বলেন, যৌথ পরিবারে শিশু সবার সাথে হেসে-খেলে বড় হবে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক বিভাগীয় প্রধান শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বাসনা মুহুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, আমি প্রতিদিন ২৩ জন শিশুরোগীকে দেখি। এর মধ্যে প্রতিদিনই ৪ থেকে ৫ জন, আবার অনেক সময় এর চেয়েও বেশি শিশুকে অভিভাবকরা নিয়ে আসছেন— যারা সময়মত কথা বলতে পারছে না। এদের প্রায় প্রত্যেকেরই বয়স ৩-৪ বছরের মতো। দেখেছি, প্রায় ১০০ ভাগ ক্ষেত্রে কথা বলতে দেরি হওয়া এই শিশুরা ৬-৭ মাস বয়স থেকেই স্মার্টফোন, আইফোন নিয়েই দিনের মধ্যে দীর্ঘ সময় কাটায়। এমনও দেখতে পাই আমার চেম্বারের ভেতরও মা শিশুকে মোবাইল ফোনটিও দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, কোনো শিশু যদি বিশেষ করে দুবছরের কম বয়সী শিশুরা প্রতিদিন ৩০ মিনিটের বেশি সময় মোবাইলে অভ্যস্ত থাকে, তবে তার expressive speech development-এ কথা বলতে পারায় ব্যঘাত ঘটতে পারে— এটা গবেষণায় পাওয়া ফলাফল।

তিনি এ সমস্যার গোড়ার কথা ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন, সমস্যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, শিশুরা খুব কম বয়স থেকেই বাবা-মায়ের মোবাইল বা ট্যাব নিয়ে কার্টুন বা অন্য ভাষার কিছু নিয়ে একা একা ব্যস্ত থাকে। অথবা শিশুকে কোনো ঝামেলা ছাড়া খাওয়ানোর জন্য মা দীর্ঘক্ষণ ডিভাইস দিয়ে ব্যস্ত রাখছেন। এতে শিশুরা যেমন আসক্ত হচ্ছে ডিভাইস নিয়ে থাকতে, তেমনি অনেকেরই কথা বলতে দেরি হচ্ছে কোনো মিথস্ক্রিয়ার অভাবে। এসব ডিভাইসের মধ্যে রয়েছে মোবাইল, ট্যাব, আইপ্যাড ও টিভি।

ডা. বাসনা মুহুরী বলেন, আজকাল অনেক শিশুই খুব কম বয়স থেকেই মোবাইল, ট্যাব, আইপ্যাড ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ব্যস্ত থাকে বা টেলিভিশনের সামনে বসে থাকে। এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে শিশুদের ওপর। যেমন— অনেক শিশুই সময়মত কথা বলা শেখে না, খিটখিটে মেজাজের হয়, দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ডিভাইসে স্ক্রিনে আটকে থাকার ফলে একধরনের আসক্তি তৈরি হয়, সামাজিকতা ও বন্ধুত্ব তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে বাধা হতে পারে। কারণ সে যদি কম বয়স থেকেই কারও সঙ্গে মেলামেশা না করে, তাহলে তার স্নায়বিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে কোনো সঠিক ঊদ্দীপনা না পাওয়ার কারণে। এর ফলে তার খাবারদাবারে অরুচি বা অনীহাও দেখা দিতে পারে।

আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকসের গবেষণার উদাহরণ টেনে ডা. বাসনা মুহুরী বলেন, ১৮ মাস বয়সের আগে কোনো শিশুকেই মোবাইল বা ট্যাব ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। পরিবারের কারও সঙ্গে যদি কোনো ভিডিও কলে কথা বলা হয়, তখন একজন অভিভাবকের সাথে কেবল ছোট্ট শিশুটি অংশ নিতে পারে।

যে কোনো বয়সেই খাবার খাওয়ার সময় কোনো স্ক্রিনটাইম দেওয়া উচিত নয় মন্তব্য করে বাসনা মুহুরী বলেন, ঘুমানোর অন্তত এক বা আধা ঘন্টা আগে থেকেই মোবাইল বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

এই সঙ্গে পরিবারের সবাই একসাথে কোথাও বেড়াতে গেলে ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে বিরত রাখার পরামর্শও দেন তিনি। তবে শিশু ডিভাইস ব্যবহার করার জন্য রাগারাগি-কান্নাকাটি করলেও, সেটা যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। কারণ একবার সায় দিলে বারবার একই জিনিস ব্যবহার করার জন্য অগ্রহণযোগ্য আচরণ বা চাহিদা বেড়ে যাবে ওই শিশুর।

বাসনা মুহুরী বলেন, শিশু সন্তান যখন কোনো ডিভাইস নিয়ে থাকে সবসময় তার সাথে থাকার চেষ্টা করুন। কারণ সে যেন এমন কিছু না দেখে— যা অগ্রহণযোগ্য। সে যা দেখে সেই বিষয়টা নিয়ে শিশুর সাথে আলাপ করুন। নিজের স্ক্রিনটাইমও সংক্ষিপ্ত করুন। যখন শিশুর সাথে কথা বলবেন তখন নিজে বিরত থাকুন মোবাইল বা ট্যাব ব্যবহার করা থেকে। চেষ্টা করুন শিশুর সাথে সময় কাটাতে। প্রতিটি কাজে শিশুর সাথে কথা বলুন, গল্প করুন, খেলার সঙ্গী হোন, পছন্দের বই পড়ে শোনান। শিশু একটু বড় হলে আপনার সাথে দৈনন্দিন কাজে সম্পৃক্ত করুন।

তিনি বলেন, শিশুর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে যত কম বয়সে হস্তক্ষেপ শুরু করতে পারবেন, ততো দ্রুত আচরণের উন্নতি হবে। তাই কোন রকম ভিন্নতা— যেমন কথা না বলা, আচরণগত সমস্যা, সময়মত বসা বা হাঁটা শুরু না করলে, বিকাশগত যে কোনো সমস্যা মনে হলে অবশ্যই শিশুর চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে হবে। কাছের হাসপাতালের শিশুচিকিৎসকের সাথে বা শিশুবিকাশ কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!