১৫০ দালালের আখড়া চট্টগ্রাম মেডিকেলে, কমিশনের ভাগ পান ছাত্রলীগ নেতারাও

দালাল হয়ে দুই গেটের ৭৫ দোকানে যায় রোগীর স্লিপ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রোগীদের আরেক আতঙ্কের নাম ওষুধ দোকানের দালাল। প্রতিদিনই সহযোগিতার কথা বলে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে কৌশলে স্লিপ নিয়ে গলাকাটা দামে ওষুধ নিয়ে দেয় এসব দালাল। বর্তমানে ১৫০ জন দালাল সক্রিয় রয়েছে মেডিকেলে। তারা মেডিকেলের মেইন গেট ও পূর্ব গেটে ৭৫টি দোকানের হয়ে কাজ করে। এসব দালালদের কেউই কোনো দোকানের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী নন। রোগীর স্লিপ এনে দিলেই তা কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করেন দোকান মালিকরা, বিনিময়ে দালালদের দেন কমিশন। আর এসব টাকার ভাগ যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংসদের নেতাদের পকেটে। দালালদের নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যেও রয়েছে এসব নেতাদের হাত।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেইন গেট ও পূর্ব গেটে প্রায় ১০০টি দোকান আছেন। এর মধ্যে ৭৫টি দোকানে দালাল দিয়ে স্লিপ ব্যবসা করা হয়। রোগীর স্বজন সেজে এসব দালালরা অন্যান্য রোগীর স্লিপ নিয়ে নেন কৌশলে। এরপর ওষুধের স্লিপ এনে দিলে সেটি তিন-চার গুণ বেশি দামে বিক্রি করেন দোকান মালিকরা। এরপর সেই টাকা থেকে ভাগ পান দালালরা। এছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডেও দালালদের পরিচিত ওয়ার্র্ডবয় ও সর্দার থাকেন। তারাও এই বিক্রির একটি কমিশন পান।

প্রতি বৃহস্পতিবার এসব দোকান থেকে ২ হাজার করে চাঁদা তোলা হয়। সেই হিসেবে প্রতি মাসে ৬ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। এসব দালালদের নিয়ন্ত্রণ করেন মেডিকেল পূর্ব গেটের ‘সিকদার মেডিকেল হল’র স্বত্বাধিকারী কফিল উদ্দিন তারেক। সব দোকান থেকে তিনি চাঁদা তুলে সেটি বণ্টন করেন বিভিন্ন জায়গায়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংসদের নেতাদেরও টাকা ভাগ পৌঁছে দেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ নেতাদের প্রশ্রয়ের কারণে হাসপাতালকে স্থায়ীভাবে দালালমুক্ত করতে হিমশিম খেতে হয়।

১৩১৩ শয্যার চট্টগ্রাম মেডিকেলে দিনে প্রায় তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। আর প্রতিদিন গড়ে হাসপাতালের কয়েকটি ওয়ার্ড থেকে অস্ত্রোপচার হয় ১৫০ থেকে ২০০টি।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৩৩ নম্বর গাইনি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন প্রসূতি মা নাদিরা বেগম। তার জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে দালালদের খপ্পড়ে পড়েন স্বামী। দুই হাজার টাকার ওষুধ তাকে কিনতে হয়েছে সাড়ে চার হাজার টাকায়। ২৩ মার্চ প্রসববেদনা নিয়ে হাটহাজারী থেকে নাদিরা এই ওয়ার্ডে ভর্তি হন। তার বাচ্চা হলে ডাক্তার ওষুধ কেনার জন্য ওই স্লিপ দেন। নাদিরার স্বামী মোফাজ্জল হোসেনের কাছ থেকে কম দামে ওষুধ কিনে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সেই স্লিপ নিয়ে নেন এক দালাল। কিন্তু পূর্ব গেটের একটি দোকান থেকে ওষুধ নেওয়ার পর চার হাজার টাকা বিল দিতে হয়। অথচ বাইরে ওই ওষুধের দাম দুই হাজার টাকা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহেনা চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালে সিজার করতে সাধারণত তিন থেকে চার হাজার টাকার ওষুধ লাগে। অনেক ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। তারপরও কিছু ওষুধ বাইরে থেকে রোগীদের কিনতে বলা হয়। কিন্তু সেটা কখনও চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার কম না।

এদিকে ওষুধ কিনে দেওয়া ছাড়াও রয়েছে বাইরে ল্যাবে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নবজাতকের কানে আযান দেওয়া, রোগী-স্বজনদেরকে ওয়ার্ডের ভেতর যেতে দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজে দালালরা উৎপাত সীমাহীন। মাঝেমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে দু-একজন দালাল ধরলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রসূতি ওয়ার্ডে ‘রোগী ভর্তি ফরম ও রোগী বৃত্তান্ত’ নামে একটি ছাপানো কাগজ থাকে। সেখানে ওয়ার্ডবয় রোগীর নাম-ঠিকানা লিখেন। ওয়ার্ডবয়ের সামনে উপস্থিত থাকেন দালাল। তারা বিভিন্ন দোকানে নিয়ে যান রোগীর স্বজনদের।

চট্টগ্রাম মেডিকেল এলাকার ৭৫টি দোকানের মধ্যে প্রতিদিন স্লিপ টানার কাজ করেন ‘হীরা ফার্মেসি‘র দালাল স্বপন, উত্তম ও মিলন। নিশাদ ফার্মেসি ও নোভা ফার্মেসি নামে আরও দুটি দোকান অধীনে। এর মধ্যে নিশাদ ফার্মেসির হয়ে আশিক এবং নোভা’র হয়ে নূর হোসেন ও পলাশ হাসপাতালে দালালের কাজ করেন।

এছাড়া ‘সজীব ফার্মেসি’র পক্ষে সজল ও ফরিদ, ‘লাজ ফার্মেসি’র পক্ষে সেলিম ও হারুন, ‘ফেনী ফার্মেসি’র পক্ষে হানিফ ও মিরু, ‘অর্ক ফার্মেসি’র পক্ষে সালাহউদ্দিন ও নয়ন, ‘তাহা ফার্মেসি’র রাজু, লিটন ও বুলবুল, ‘সিকদার ফার্মেসি’র পক্ষে রয়েল, মিন্টু ও দুলাল দালালি করেন।

‘জনতা ফার্মেসি’র পক্ষে জিকু ও বাবু, ‘সানন্দা ফার্মেসি’র ওয়াসিম, ‘রিনা ফার্মেসি’র সঞ্চয় ও নিতাই, ‘ন্যাশনাল ফার্মেসি’র উত্তম, তপন ও নিতাই, ‘জয় ফার্মেসি’র রুবেল ও উত্তম, ‘মেডিসিন ফার্মেসি’র নিলয়, মিতুল ও ইরানী, ‘একুশে ফার্মেসি’র বাবু, সজীব ও জাহাঙ্গীর, ‘সিটি ফার্মেসি’র শাহজাহান, ফারুক ও সাইফুল, ‘বি কে ফার্মেসি’র উৎপল ও সুমন, ‘সাহা ফার্মেসি’র শয়ন; ‘সবুজ ফার্মেসি’র জসিম, আনোয়ার, মৃদুল ও সুমন, ‘সাহান ফার্মেসি’র নুনু বাবু ও নিমাই, ‘জয়নাব ফার্মেসি’র কার্তিক ও ফারুক, ‘অয়ন ড্রাগ ফার্মেসি’র তপন ও ওমর, ‘লোটাস ফার্মেসি’র জাহাঙ্গীর ও বাবু এবং ‘রাঙ্গুনিয়া ফার্মেসি’র পক্ষে রাসেল, সুমন, এমদাদ ও জসিম দালালির কাজ করেন।

এছাড়া মেইন গেট সংলগ্ন দোকানগুলোর হয়ে প্রবীর, রঞ্জন, সালাম, ইদ্রিসসহ ১০ জনের একটি সিন্ডিকেট কাজ করে। এরা হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে রোগীর স্বজনদের দোকানগুলোতে নিয়ে আসেন।

দালাল নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে সিকদার মেডিকেল হলের স্বত্বাধিকারী কফিল উদ্দিন তারেকের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগ নেতা অভিজিৎ দাশ বলেন, ‘আসলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ সক্রিয়, নেই কোনো কমিটি। সবাই সবার জায়গায় রাজা। তবে অন্য কারও কথা জানি না, আমি সবসময়ই দালাল নির্মূলে সোচ্চার। আগের পরিচালককে আমরা দালালদের দৌরাত্ম্য দমনে স্মারকলিপিও দিয়েছিলাম। আমি ও আমাদের আ জ ম নাছির সমর্থিত যেসব কর্মী রয়েছে, আমরা চাই মেডিকেল থেকে দালাল নির্মূল হোক।’

অভিজিৎ দাশ আরও বলেন, ‘আমরা যখন পরিচালকদের দালালদের নিয়ে স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলাম, তখন ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কেউ কেউ বিরাগভাজন হন। নিশ্চয় সেখানে তাদের স্বার্থ আছে। এ বিষয়টা নিয়ে সাংবাদিকরা খোঁজ নিতে পারেন। আমি এটাই জেনেছি, দালালদের নিয়ন্ত্রণ করে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কনক দেবনাথ বলেন, আমি ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতা। আমি সবসময়ই চাই হাসপাতাল দালালমুক্ত হোক। আমি নওফেল সমর্থক, আ জ ম নাছির সমর্থিত ইন্টার্ন অ্যাসোসিয়েশন দালালদের মদদ দিয়ে থাকে। এটি নিয়ে একাধিকবার আমরা হাসপাতাল পরিচালকেকে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। কিন্ত তখন অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা নাখোশ হয়। আমরা ক্লিন ইমেজের ডাক্তার।

চট্টগ্রাম মেডিজেল কলেজ ও হাসপাতালের ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. মুকেশ রঞ্জন দে বলেন, এসব অভিযোগ অবান্তর, অবাস্তব। বুঝি না কে বা কোন গোষ্ঠী বরাবরই আ জ ম নাছির সমর্থিত অনুসারীদের বিভিন্ন বিষয়কে সামনে এনে আমাদের ফ্যাঁসাদে ফেলতে চায়। আমরা বরাবরই দালাল নির্মূলে বদ্ধপরিকর। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে দালালদের পুলিশের হাতে পাকড়াও করতে সহায়তা করেছি। আমরা মানুষের সেবা করতে এ পেশায় এসেছি। আমরা কেন সেবা বিঘ্নকারীদের সহায়তা করতে যাব?’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘র‍্যাবের সম্প্রতি ঝটিকা অভিযানে যে ৩৯ জন দালাল আটক হয়েছে, তারা সবাই হাসপাতালের বাইরের। একজন যিনি স্টাফ ছিলেন, তার অভিযোগ তদন্ত চলছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দালাল যাতে হাসপাতালে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে স্ট্রিক ছিলাম এবং আছি। তবে দালালরা যদি অন্য কোথাও থেকে মোটিভেটেড হয়ে থাকে সেই সোর্সও আমি খুঁজে বের করব।’

ছাত্রলীগ নেতারা দালালদের নিয়ন্ত্রণ করছে কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অমূলক কোনো তথ্য নিয়ে কাউকে ধরা যায় না। আমি স্পেসিফিক তথ্য নিয়ে কাজ করি। তবে কোনো দালালের এ হাসপাতালে জায়গা হবে না।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!