সবুজ পাহাড়ে জুমের থেকে ধান কাটার উৎসব শুরু হয়েছে। পাহাড়ে পাহাড়ে চলছে এই উৎসব। উৎসব শেষে ফলন বিক্রি করে স্বপ্ন পূরণ করবেন জুমচাষিরা।
সোনালী ফসল দোল খায় জুমিয়াদের। জুম ধান এখন হাসি ফোটাচ্ছে জুমচাষিদের মুখে। জুমের ফসল বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে তারা ঘরের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনেন। এক মৌসুমের ফসল দিয়ে একটি বছর চলে তাদের।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যবাহী জুমচাষ। পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জুমিয়ারা ঐতিহ্যগতভাবে জুমচাষে নির্ভর করে জীবনধারণ। ধান, ভূট্টা, তিল, মিষ্টি কুমড়া, চিনার, মারফাসহ বিচিত্র রকমের ফসল ফলায়। এখন জুমের পাকা কাটা চলছে। পাহাড়ের আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় ভালো ফলন হয়েছে। এখন ধান কাটা ও ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা।
খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গা উপজেলার দুর্গম হাচুকপাড়ার জুমচাষি রতন ত্রিপুরা, সাগর ত্রিপুরা ও দোলন ত্রিপুরা বলেন, স্বপ্নপূরণের দিন চলে এসেছে। এখন জুমের ধান কাটার কাজে ব্যস্ত সবাই। পরিবারের সকল সদস্যরা ধান কাটছে। হলুদ, কন চাউল, বিনি চাউল তোলা শেষ হলে আর কোনো চিন্তা নেই।
মাটিরাঙ্গা উপজেলার রিসাং ঝরনা এলাকার জুমচাষী মনিবালা ত্রিপুরা, বাসন্তী ত্রিপুরা বলেন, আমরা জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। সারা বছর কষ্টের পর এখন ঘরে ফলন তোলার সময়। গত বছরের তুলনায় এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ধান কাটি। সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময় হলে খালুং ভর্তি ধান ঘরে নিয়ে যাই।
জুমচাষি নবজ্যোতি ত্রিপুরা বলেন, এমন একটা সময় ছিল যখন এক পাহাড়ে জুম চাষ করার পর অন্য পাহাড়ে জুম চাষ করা হতো। কিন্তু এখন মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে বসতি। তাই জুমের জায়গা কমে আসছে। এখন একই স্থানে প্রতি বছর জুম চাষ করতে হচ্ছে।
উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা স্থায়িত্বশীল এবং অধিক উৎপাদনশীল জুমচাষের উপায় বের করার গবেষণা করছেন। এই গবেষণায় মূলত সার ও কীটনাশকের পরিমিত ব্যবহারের মাধ্যমে একই জমিতে প্রতি বছর জুমচাষের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গত চার বছর ধরে চলা গবেষণায় বৈজ্ঞানিক ও কৃষিবিদরা খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সফলতার মুখ দেখছেন অনেকটাই। এতে উদ্বুদ্ধ জুম কৃষকরাও।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এই বছর জেলায় এক হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে জুম চাষ হয়েছে। যেখান থেকে দুই হাজার ৯৮৬ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মর্তুজা আলী বলেন, মূলত স্থানীয় জাত থেকে জুমের উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশ পারমাণবিক ইনিস্টিটিউট বিনা ধান-১৯ এবং বিনা ধান-২১ উদ্ভাবন করেছে— যা কিনা স্থানীয় জাতের তুলনায় ভালো ফলন দিচ্ছে। এছাড়াও বিরি ধান-৮৩ এবং চায়নতেও স্থানীয় জাতের তুলনায় ভালো ফলন হচ্ছে।
খাগড়াছড়ি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্সী রশিদ আহম্মেদ বলেন, জুম চাষ পার্বত্য অঞ্চলে সনাতল পদ্ধতি। এই পদ্ধতির চাষটা যথেষ্ট লাভজনক না হলেও এই অঞ্চলের পাহাড়ি জমিতে জীবনধারণের জন্য এটির আসলে বিকল্প নেই। জুমচাষটি বছরে একবারই হয়— বর্ষা মৌসুমে। এটি বৃষ্টিনির্ভর কৃষি এবং জুম চাষে ধান থেকে শুরু করে তিল মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা ও তুলা এক সঙ্গে চাষ হয়।
তিনি বলেন, মার্চ-এপ্রিলে পরিস্কার করে শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে তারপর বিভিন্ন ফসলের বীজ একসঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয়। মাঝে কিছু পরিচর্যা করতে হয়। অক্টোবর থেকে নভেম্বরের প্রথম পর্যন্ত ধান কাটা হয়।
সিপি