ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানের প্রথম শিরোপা জয়!

ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানের প্রথম শিরোপা জয়! 1ক্রীড়া ডেস্ক : ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেই আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা জিতলো পাকিস্তান- কথাটা এভাবে বললেও একদম ভুল হবে না। কে ভেবেছিল? ১৮০ রানে ফাইনাল জিতে শিরোপা উৎসব পাকিস্তানের! ৩৩৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করে ৩০.৩ ওভারেই মাত্র ১৫৮ রানে ভারতের নটেগাছটি মুড়িয়ে গেলো! বিশ্বাস হয়?

ভারত সেই ২০০৪, ২০০৫ এ চিরশত্রু পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৫৬, ৩৪৯ রানও করেছে। হারেনি। আবার ৩৩০ রানের লক্ষ্য জয় করেও জিতেছে। কিন্তু এর কোনোটা তো আইসিসির বৈশ্বিক আসরের ফাইনাল ছিল না। এই প্রথম আইসিসির ওয়ানডে টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল। আর ওভাল পুরোপুরি ভারত-পাকিস্তানের মাঠই হয়ে উঠেছিল সমর্থকদের কারণে। কিন্তু ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেটা কেবল পাকিস্তানের ভক্ত-সমর্থকদের একচ্ছত্র আধিপত্যের মাঠ হয়ে রইলো। তাদেরই কণ্ঠ আর উৎসব। ফখর জামানের (১১৪) অসাধারণ সেঞ্চুরি এলো যে ফাইনালে সেটিতে মোহাম্মদ আমিরের নেতৃত্বে পাকিস্তানের বোলিংও পুরোনো দিনের মতো জ্বলে উঠলো। ব্যাটিংয়ে পাকিস্তান ভারতের বোলিংকে পোড়ালো আগে। তারপর প্রতিপক্ষের ব্যাটিংকে ছাইভস্ম করলো দুর্দান্ত বোলিংয়ে।

পাকিস্তান ৪ উইকেটে করেছিল ৩৩৮ রান। ভারতের বিপক্ষে তাদের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান। কিন্তু ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপের সামনে সেটিও অনেকে নিরাপদ ভাবেননি। ফখর আর আজহার আলির ওপেনিং জুটি ২৩ ওভারেই করেছিল ১২৮ রান। গোটা দল মিলে ভারত কি না তার চেয়ে মাত্র ৩০ রান বেশি করলো! চোটে সেমি-ফাইনাল মিস করা আমির শুরুতেই ৩ উইকেট নিয়ে ভারতের ব্যাটিংকে দিলেন প্রবল ধাক্কা। সেই ধাক্কায় সেরা ব্যাটিং খোড়াতে শুরু করে। হাসান আলি আর শাদাবের আঘাত যোগ হলে ৭২ রানে নেই ৬ উইকেট! প্রথম ৬ ব্যাটসম্যানের দুজন মাত্র ২০ পেরিয়ে সামান্য হাঁটলেন। বাকী চারের রানের যোগফল মাত্র ১৮! সবাই এক অংকে নেই!

অবিশ্বাস্য এই ফাইনালে সপ্তম উইকেট জুটিতে জাদু দেখিয়েও বাকি ৩৩ ওভারে জয়ের জন্য দরকারী ২৬৭ রান কি করতে পারতো ভারত? হার্দিক পান্ডিয়া যৌবনের প্রচণ্ড দাপট দেখাতে শুরু করলেন। রবীন্দ্র জাদেজাকে নিয়ে। ৯.৩ ওভারে ৮০ রানের জুটি। শাদাবকে পরপর তিন ছক্কা হাঁকান হার্দিক। মারতে থাকেন। কিন্তু ফখর আর আজহার যেমন একপ্রান্তে গিয়ে হাজির, রান আউটে শেষ, সেভাবেই জাদেজা-হার্দিক একপ্রান্তে। নিজেকে না কাকে গালি দিতে দিতে হার্দিক ফেরেন ৪৩ বলে ৬ ছক্কা ও ৪ চারের ঝকঝকে ৭৬ রান নিয়ে। ভারতের ব্যাটিং ইনিংসে বীরত্ব বলতে ওইটুকুই। আমিরের ৩ উইকেট, হাসানের ৩ উইকেট, শাদাবের ২। তাতেই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ফেভারিট বিরাট কোহলির ভারত ফাইনালে পরাজিত কোনো ছোটো এক দলের মতো। আর প্রথমপর্বেই যারা বিদায়ের মুখে ছিল সেই পাকিস্তান সরফরাজ আহমেদের নেতৃত্বে লিখল অবিশ্বাস্য এক ইতিহাস। প্রথমবারের মতো আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির চ্যাম্পিয়ন হয়ে মাঠেই সিজদায় নতজানু গোটা পাকিস্তান দল। এ যেন ঘোর লাগা বিশ্বাস না করার মতোই ফাইনাল!

এর আগে আইসিসির সব টুর্নামেন্ট মিলে ১৫ ম্যাচে ভারতকে মাত্র দুবার হারিয়েছে পাকিস্তান। ওই দুবারই ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। তৃতীয় জয়টা সেই টুর্নামেন্টে তুলে নিয়ে পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা ইতিহাসে নিশ্চিত করলেন অমরত্ব। ২০০৯ সালের পর এই প্রথম আরেকটি বৈশ্বিক শিরোপা উঠলো পাকিস্তানের ঘরে। সেবার জিতেছিল একমাত্র টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপাটি। তারও আগে ১৯৯২ সালে একবারই বিশ্বকাপ জিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারা। বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের ৮ নম্বর দল হিসেবে শুরু করা পাকিস্তান তাদের ইতিহাসের তৃতীয় বৈশ্বিক শিরোপা জিতে বর্তমানের আট দলের মধ্যে সেরা হয়েই রূপকথার মতো এক গল্প শেষ করলো। যে গল্পে শেষ ভালো যার সব ভালো তার।

এমন খেলায় আসলে পাকিস্তানের দোর্দণ্ড প্রতাপ আর ভারতের অসহায়ত্ব ছাড়া লেখার কিছু থাকে না। ওভালে শেষ ৬ ম্যাচের প্রথম ইনিংসের গড় স্কোর ছিল ২৬৭। সেটি স্লগ ওভারে রেখে পার হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। টস হেরে ইনফর্ম ওপেনিং জুটি আজহার ও ফখর রাজত্ব গড়েছেন। ব্যক্তিগত ৩ রানের সময় আউট হতে পারতেন ফখর। জসপ্রিত বুমরাহর ‘নো’ বল জীবন দিয়েছে। ক্যাচ দিয়েও বেঁচেছেন। এরপর ফখরের ব্যাটে দারুণ ঔদ্ধত্ব। আজহার তার ভুলে ৫৯ রানে রান আউট হলে আরো ক্ষেপে ওঠেন বাঁহাতি ফখর। ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিটা তুলে নেন চতুর্থ ম্যাচেই।

দ্বিতীয় উইকেটে ফখর ও বাবর ৭২ রানের জুটি গড়েছেন। তৃতীয় উইকেটে বাবরের সাথে শোয়েব মালিকের ৪৭ রানের জুটি। চতুর্থ ওভারটা ২০ রানের। কিন্তু শেষ ৭.৩ ওভারে মোহাম্মদ হাফিজ ও ইমাদ ওয়াসিমের ৯.৪৬ গড়ে অবিচ্ছিন্ন ৫ম উইকেটের জুটিটা দলের টিলাটাকে পাহাড় বানিয়েছে দ্রুত। সবাইকে ছাপিয়ে অবশ্য ওপেনার ফখরের নামটা আসে আগে। ১০৬ বলে ১২ চার ও ৩ ছক্কায় ১১৪ রানের ইনিংস খেলে গেছেন। শেষে ছিলেন দারুণ মারমুখী। ভারতীয় বোলাররা ছন্দ হারিয়েছেন। ফর্মে থাকা আজহার ৭১ বলে ৫৯ রান করেছেন। বাবর আযম এই ক্ষণকেই রান করার জন্য বেছে নিলেন। ৫২ বলে ৪২ তার। শোয়েব মালিক কিছু করতে না পারলেও আরেক অভিজ্ঞ মোহাম্মদ হাফিজ দারুণ খেললেন। ৩৭ বলে ৫৭ রানে অপরাজিত তিনি। ২১ বলে ২৫ রানে অপরাজিত ইমাদ ওয়াসিম। ভুবনেশ্বর কুমার ছাড়া সব বোলার ছিলেন রান দিতে উদার। হার্দিক পান্ডিয়া সামান্য নিয়ন্ত্রণে ছিলেন।

পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের থেকে বোলারদের মাঝেও প্রবাহিত বিশ্বাসের সেই বারুদ। যে পাকিস্তানের টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় হয়ে যাওয়ার অবস্থা শুরুতেই, চিরশত্রু ভারতের সামনে সেই তারা প্রচণ্ড প্রতিপক্ষ। চোট থেকে ফিরে মোহাম্মদ আমির প্রথম ওভারেই আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান রোহিত শর্মাকে (০) তুলে নেন। দুই ওভার পরেই দুর্র্ধষ ফর্মে থাকা ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি (৫) আমিরের বলে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন শাদাব খানকে। ওই শাদাবই পরে স্পিনে আরো সর্বনাশের কারণ ভারতের। তবে তার আগে ইনিংসের নবম ওভারে আরেক উইকেট আমিরের। ইনফর্ম শিখর ধাওয়ান (২১) উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন।

যুবরাজ সিং, এমএস ধোনিরা আছেন। কিন্তু তরুণ স্পিনার শাদাব অভিজ্ঞ যুবরাজকে (২২) এলবিডাব্লিউর শিকার বানিয়ে ফেলেন। ৫৪ রানে ৪ উইকেট নেই ভারতের। কি হবে? পরের ওভারেই ধোনি (৪) টুর্নামেন্টের সেরা বোলার হাসান আলিকে উইকেট দিয়ে ফিরলে পাকিস্তান দল যেন ম্যাচ জেতার উৎসবই করে ফেলে! ১৭তম ওভারে শাদাবের দ্বিতীয় শিকার কেদার যাদব (৯)। ভারতের বিশ্বখ্যাত ব্যাটিং লাইন আপ ১৭ ওভারে ৬ উইকেটে ৭২! একি কাণ্ড!

জাদেজাকে (১৫) নিয়ে হার্দিক ১৫২ রান পর্যন্ত গেলেন। কিন্তু যে বিশাল রানের চাপ ও বোলিংয়ের ধারে কেটে কুটিকুটি ভারতের ব্যাটিংয়ের শ্রেষ্ঠরা সেই চাপ সামলে লোয়ার অর্ডার আর কি করতে পারে? ক্রিকেটে এমন পরিস্থিতিতে অলৌকিকতার জায়গা মেলে না। শেষ ৪ উইকেট মাত্র ৬ রানে হারিয়ে ভারতের এই ফাইনাল দুঃখের গল্পটা নিদারুণ লজ্জাতেই নেয় রূপ। পাকিস্তান তো তখন সপ্তম স্বর্গে। সারা দুনিয়ার দর্শকদের জন্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালটা তাই শেষ প্রবল অবিশ্বাসের রেশ নিয়ে। এমন ফাইনালও হয়!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

পাকিস্তান ইনিংস: ৩৩৮/৪ (৫০ ওভারে) (আজহার ৫৯, ফখর ১১৪, বাবর ৪৬, মালিক ১২, হাফিজ ৫৭*, ইমাদ ২৫*; ভুবনেশ্বর ৪৪/১, বুমরাহ ৬৮/০, অশ্বিন ৭০/০, হার্দিক ৫৩/১, জাদেজা ৬৭/০, কেদার ২৭/১)।

ভারত ইনিংস: ১৫৮ অলআউট (৩০.৩ ওভারে) (রোহিত ০, শিখর ২১, কোহলি ৫, যুবরাজ ২২, ধোনি ৪, কেদার ৯, হার্দিক ৭৬, জাদেজা ১৫, অশ্বিন ১, ভুবনেশ্বর ১*, বুমরাহ ১; আমির ১৬/৩, জুনাইদ ২০/১, হাফিজ ১৩/০, হাসান ১৯/৩, শাদাব ৬০/২, ইমাদ ৩/০, ফখর ২৫/০)।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!