ফেসবুকের পোস্ট নিয়ে চবি শিক্ষকের ‘শাস্তি’ চায় শিক্ষক সমিতি, সমালোচনার ঝড়

ফেসবুকে ‘সরকারবিরোধী’ পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ তুলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে শাস্তি দেওয়ার ‘জোর দাবি’ জানিয়েছে খোদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

রোববার (২০ আগস্ট) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভায় গৃহীত এক ‘সর্বসম্মত’ সিদ্ধান্তে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী দক্ষতা ও শৃংখলা সংবিধি অনুযায়ী ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর ‘জোর দাবি’ জানানো হয়েছে।

শিক্ষক সমিতির সভায় অভিযুক্ত ওই শিক্ষক হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম। জানা গেছে, বর্তমানে গবেষণা ছুটি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী এবং সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর আবদুল হক স্বাক্ষরিত ‘সর্বসম্মত’ সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়— ‘সম্প্রতি সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক জনাব মোঃ মাইদুল ইসলাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তাঁর ফেইসবুক পেইজে “StepDownHasina” লিখে পোস্ট প্রদানসহ সরকার প্রধান এবং গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে নানান ধরনের কুৎসা রটনা করে যাচ্ছেন। ইতিপূর্বেও জনাব মাইদুল ইসলাম মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামে বিভিন্ন কুৎসা রটনাসহ আপত্তিকর পোস্ট প্রদান করেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক হিসেবে চরম অসদাচরণের শামিল এবং এ কারণে বিগত ২৩-০২-২০২১ তারিখ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে জনাব মাইদুল ইসলাম এর বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত আইন, ২০০৯) অনুসারে দায়েরকৃত একটি মামলার সর্বশেষ অবস্থা অবহিত করার অনুরোধ সহকারে উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর (সূত্র: ৩৭.০০.০০০০.০৭৯.২৭.০৪১.৯৬.৮০) পত্র প্রদান করা হয়। এ প্রেক্ষিতে মাননীয় উপাচার্যের পক্ষ থেকে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানার জন্য এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী দক্ষতা ও শৃংখলা সংবিধি অনুযায়ী জনাব মাইদুল ইসলাম এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর জোর দাবি জানানোর জন্য অদ্যকার সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।’

এ প্রসঙ্গে রোববার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর আবদুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আমরাও গঠনমূলক আলোচনা করি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও সরকারের বেতনভুক্ত কোনো কর্মচারী সরকার বা সরকার প্রধানের পতনের জন্য জনগণকে আহবান জানাতে পারেন না। তিনি (শিক্ষক মাইদুল ইসলাম) স্টেপ ডাউন হাসিনা লিখে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন; সরকারি বেতনভুক্ত হিসেবে তিনি এভাবে লিখতে পারেন না। তিনি ৭৩ অ্যাক্টও লঙ্ঘন করেছেন।’

এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত শিক্ষক মাইদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘গণ-মানুষের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। তাই, এই প্রতিষ্ঠান যে কোন সরকারের কিংবা একক কোন গোষ্ঠীর অথবা কারো বাপ-দাদার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। এই প্রতিষ্ঠান তাই সরকারি কোন দলের খোঁয়াড় নয়। এটি এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট যে দেশে আইনের ন্যায্য শাসন নেই, জবাবদিহিতা নেই, জনগণের ভোটাধিকার নেই, তাই গণতন্ত্রও সেখানে অনুপস্থিত । যেহেতু এইসব আওয়ামীলীগের ক্ষমতাসীন থাকার সময় ঘটেছে তাই আমি জনগণের ভোটাধিকার এবং গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবী জানিয়ে #StepDownHasina আমার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছি। অনলাইন বা অফলাইন নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারা আমার নাগরিক, রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক অধিকার।’

মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘যে শিক্ষক সমিতি এর আগে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের দ্বারা আমি নিপীড়িত হবার সময় আমার পাশে দাঁড়ায় নি, বারবার যোগাযোগ করার পরও কোন সাড়া দেয় নি আজ তারা আমার সহকর্মী হবার পরও অন্যায়ভাবে আমার বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিতে উঠে পড়ে লেগেছে এটি যে আদতে তাঁদের নিজের পায়ে নিজেদেরই শিকল পরানোর বন্দোবস্ত। নিজেরাই নিজেদের কারাগারে বন্দী করে ফেলছে, , কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারাগারে রূপান্তরিত করে ফেলা হচ্ছে,এই বোধটুকু তাঁদের ভেতর জাগ্রত হোক। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি মতপ্রকাশের অধিকারের প্রাথমিক ধারণা রাখে না বা রাখতে চায় না এটা অত্যন্ত দু:খজনক ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বোধোদয় হোক, শিক্ষক সমিতিগুলোর বোধোদয় হোক।’

এদিকে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে খোদ শিক্ষক সমিতির এমন অবস্থানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। ফেসবুকে অনেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক খ. আলী আর রাজী শিক্ষক সমিতির এমন সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিশ্বাস করতে পারছি না। তবে যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী!’

আফসার আহমেদ নামে একজন লিখেছেন, ‘বিরক্তিকর। এরা শিক্ষক? এই সব সমিতির দরকার কি? এরা কী পড়াবে, জাতিকে কী দিবে?’

জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পক্ষে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘কটুক্তি’ করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইফতেখারুল ইসলাম। ওই বছরের ৬ আগস্ট হাইকোর্ট থেকে তিনি আগাম জামিন নেন। হাইকোর্টের দেওয়া আট সপ্তাহের জামিন শেষে চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন মাইদুল ইসলাম। আদালত তা নাকচ করে দিয়ে ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাইদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এরপর ৯ অক্টোবর উচ্চ আদালত শিক্ষক মাইদুলকে ছয় মাসের জামিন দেন এবং উচ্চ আদালতে মামলাটি স্থগিত করা হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!