পুড়িয়ে স্ত্রী খুনের হোতা বন্দরের পিল্টু চলেন সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে

নৌমন্ত্রীর ‘এপিএস’ পরিচয়ে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা

আগুনে পুড়িয়ে স্ত্রীকে খুনের পাঁচ বছর পর চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেন সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে চলা চট্টগ্রামের সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী শেখ নওশেদ সরোয়ার পিল্টু। টাকা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং মামলার দুর্বল তদন্ত— এতদিন বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দাবি করা পিল্টুকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছিল। চট্টগ্রামের বন্দর থানা ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি নিজেকে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সাবেক সদস্য হিসেবেও জাহির করে থাকেন।

চট্টগ্রামের বন্দর এলাকায় রীতিমতো দাপটের সঙ্গে চলা এই পিল্টু অবশেষে গত শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) খুলশী এলাকায় নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে ধরা পড়েন। রোববার (২৯ নভেম্বর) চট্টগ্রামের মহানগর হাকিম শফিউদ্দিনের আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন চাওয়া হলে আদালত শুধু একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় পিন্টুর ‘অফিসে’ সন্ধ্যার পর অপরাধীদের আড্ডা জমে ওঠে। মেহেদীবাগে রয়েছে তার কোটি টাকার ফ্ল্যাট বাড়ি এবং রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিকের অ্যাপোলো হাসপাতালের কাছেও রয়েছে আরেকটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট।

আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে পিন্টু নিজেকে তৎকালীন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহাজান খানের ‘এপিএস’ পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ক্যারেট ব্যবসার দখল নিয়েও কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন— এমন অভিযোগ বহুদিনের। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের লিখিত কোনো অনুমোদন ছাড়াই মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে এসব ব্যবসা দখলে নেন তিনি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর গোসাইলডাঙ্গার মৃত শেখ দেলোয়ার হোসেনের ছেলে শেখ নওশেদ সরোয়ার পিল্টুর সাথে রাউজানের গহিরা ইউনিয়নের মৃত কাজী আহমদ কবিরের মেয়ে কাজী কানিজ ফাতেমা সুমাইয়ার বিয়ে হয়। সুমাইয়াকে বিয়ে করতেও আরেক কাহিনীর জন্ম দিয়েছিলেন পিল্টু। ওই মেয়ের সঙ্গে মূলত বিয়ের কথাবার্তা চলছিল পিল্টুর মাদকাসক্ত এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু মেয়ে দেখতে গিয়ে পিল্টুর কুনজরে পড়ে যান সুমাইয়া। নানা ছলে গোপনে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন পিল্টু।

বিয়ের পর সুমাইয়া জানতে পারেন ফরিদা ইয়াসমিন পরী নামে আরও এক স্ত্রী রয়েছে পিল্টুর। এ নিয়ে দুজনের মাঝে নিয়মিত ঝগড়া হতো। পিল্টু নিয়মিতই সুমাইয়ার ওপর নির্যাতন চালাতেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালে একটি মামলা করেন সুমাইয়া। মামলার জেরে নওশেদ তার কর্মচারীদের নিয়ে সুমাইয়াকে হত্যা করে এবং লাশ গুম করার জন্য চন্দনাইশ উপজেলার সুচিয়া গ্রামের শ্মশানের পাশে দাহ্য পদার্থ দিয়ে লাশের চেহারাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়িয়ে ফেলে বলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডির তদন্তে উঠে আসে।

তবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও পিল্টু ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানা গেছে, সুমাইয়াকে খুন করার পর পিল্টু পালিয়ে চলে যান এক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতার আশ্রয়ে। ২০১২ সাল থেকে তার সঙ্গে সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এরশাদুর রহমান চৌধুরীর সম্পর্ক। ওই সময়ে নগরীর ফকিরহাট এলাকায় পিন্টুর একটি অফিসে এরশাদুর রহমান চৌধুরীর বেশ যাতায়াত ছিল। এরশাদের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। এরশাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলে কিছুদিন রেখে পরে পিল্টুকে ঢাকা বিমানবন্দর সড়কে একটি বাসা নিয়ে দেন। ওই বাসায় দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে ছিলেন পিল্টু। পরে পিল্টুর চাচাতো বোনের সঙ্গে বিয়ে হয় এরশাদের। যদিও খুনের পর পিন্টুকে সহযোগিতার কথা বিভিন্ন সময়ে অস্বীকার করেছেন সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এরশাদ।

এদিকে তদন্ত শেষে ২০১৭ সালে আদালতে সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত আসামি ফরিদা ইয়াসমিন পরী ও নওশেদ পিল্টুর বড় ভাই প্রিন্সকে বাদ দেওয়া হলে মামলার বাদি নিহত সুমাইয়ার মা সৈয়দা দিলরুবা বেগম আদালতে নারাজি দেন। তারই প্রেক্ষিতে আদালত এই মামলা পুনঃতদন্তের জন্য নগর গোয়েন্দা পুলিশকে আদেশ দেন।

আদালতের আদেশ পেয়ে মামলার তদন্তে নেমে নগর গোয়েন্দা বিভাগ নওশেদ পিল্টুর সম্পৃক্ততা পায় বলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রউফ। তিনি বলেন, ‘এক বছর নিবিড় তদন্তের পর আমরা নগরীর খুলশী এলাকা থেকে নওশেদ পিল্টুকে আটক করেছি। আটকের পর রোববার (২৯ নভেম্বর) মহানগর হাকিম শফিউদ্দিনের আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জিজ্ঞাসাবাদেই জানা যাবে এই হত্যাকাণ্ডে আর কে কে জড়িত ছিল।’

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল দুপুরে মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির বাসা থেকে সুমাইয়াকে কাজের ছেলে এমরান বাবুকে দিয়ে ডেকে পাঠান স্বামী নওশেদ পিল্টু। স্বামীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় কাজের বুয়া নাসিমা খাতুনের কাছে নয় মাসের শিশু জিহাদকে রেখে যান। রাত ১০টায় এসে নওশাদ ও তার কর্মচারী এমরান বাবু এসে জিহাদকে নিয়ে যান। এ সময় তারা কাজের বুয়াকে হোটেল থেকে রাতের খাবারও দিয়ে যান। আবার ভোর রাত ৪টায় জিহাদকে বাসায় এনে কাজের বুয়ার কাছে রেখে যান। পরদিন আবার দুপুরে এসে নিয়ে যান। এই ঘটনা ওই দিন অর্থাৎ ৮ এপ্রিল বিকেলে কাজের বুয়া নিহত সুমাইয়ার ভাবীকে বলেন। ভাবী তার মা দিলরুবা বেগমকে জানান। দিলরুবা বেগম মেয়ের স্বামী নওশেদ পিল্টুর মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে সংযোগ কেটে দেন।

পরদিন ৯ এপ্রিল দিলরুবা বেগম বাদি হয়ে পাঁচলাইশ থানায় নওশেদ পিল্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের কথা শুনে নওশেদ আরও বেপরোয়া হয়ে নিজের শ্বাশুড়ি ও শ্যালকদের বিভিন্ন হুমকি দেন। এর এক সপ্তাহ পর ১৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় শিশু জিহাদকে এশিয়ান হাউজিংয়ের গাজী ম্যানশনের সিঁড়ির নিচে রেখে চলে যান। তখন পাঁচলাইশ থানায় খবর দিলে তৎকালীন ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ এসআই জাহেদ হোসেনকে ঘটনাস্থলে পাঠান। এসআই জাহেদ হোসেন শিশু জিহাদকে তার নানীর কাছে বুঝিয়ে দেন। তবে থানায় মামলা করতে গেলে মামলা না নিয়ে ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ বাদীকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন। দিলরুবা বেগম এরপর ওই বছরের ২১ এপ্রিল আদালতে মামলা দায়ের করেন।

এরই মধ্যে ৮ এপ্রিল চন্দনাইশ থানা পুলিশ সুচিয়া গ্রামের শ্মশানের পাশ থেকে আগুনে পোড়া একটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। সুমাইয়ার মা-ভাইসহ স্বজনরা ওই লাশ দেখেও চিনতে পারেননি। এমন অবস্থায় পুলিশ সুমাইয়ার লাশ আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে দিলে তারা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে। দাফনের আগে সুমাইয়ার কাছ থেকে নেওয়া টিস্যুর ডিএনএ পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় লাশটি ছিল সুমাইয়ার।

সুমাইয়াকে খুন করার অভিযোগে পুলিশ সুমাইয়ার স্বামী নওশেদ পিল্টুর অফিসের কর্মচারী আনোয়ার হোসেন লিমন, রানা চৌধুরী ওরফে মাইকেল, এমরান বাবু ও মামাত ভাই সাজ্জাদুর রহমান শুভকে আটক করেন। এদের মধ্যে এমরান বাবু ও আনোয়ার লিমন খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতে উঠে আসে প্রথম স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন পরীর প্ররোচণায় স্বামী শেখ নওশেদ সরোয়ার পিল্টুর নির্দেশে তারা সুমাইয়াকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করে। আদালতে এই স্বীকারোক্তি থাকার পরও পরীর নাম অভিযোগপত্র থেকে উধাও হয়ে যায়।

মামলার এজাহারে এক নম্বর অভিযুক্ত এবং হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত দুজনের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসা খুনি নওশেদ বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের নেতা হিসেবে নিজের পরিচয় দেন। তিনি নিজেকে বন্দর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সাবেক সদস্য হিসেবেও জাহির করে থাকেন। তার রাজনৈতিক এই প্রভাবের পাশাপাশি অর্থবিত্তের প্রভাবের বিষয়টি মামলার তদন্তে সম্পৃক্ত একাধিক পুলিশ কর্মকতা স্বীকার করেছেন। এছাড়াও তার এসব প্রভাবেই পাঁচলাইশ থানার তৎকালীন ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ সুমাইয়াকে অপহরণ এবং খুনের এতগুলো স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েও নওশেদ পিল্টুকে আটক করেননি বলে সুমাইয়ার পরিবারের অভিযোগ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!