পরীক্ষা নিয়ে বাণিজ্যে মেতেছে চবির সাংবাদিকতা বিভাগ, অধ্যাদেশকে বুড়ো আঙ্গুল

১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রীতিমতো বাণিজ্যে নেমেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়ে ৮১ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের নামে চার লক্ষ টাকারও বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে— যা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পরিপন্থী। সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। আর এ ঘটনায় অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে বিভাগের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি রওশন আখতারের দিকে। তিনিই প্রভাব খাটিয়ে এই টাকা আদায় করছেন, যা খরচও হবে তার নিজের ইচ্ছায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স অনুসারে জরিমানা করা ৮১ শিক্ষার্থীর কেউই পরীক্ষায় ফরম ফিলাপের যোগ্য নয়। অর্থাৎ শতকরা হিসেবে ৬০-এর নিচে থাকলে কাউকেই পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু নতুন দায়িত্ব নিয়ে সভাপতি একক ক্ষমতাবলে সাড়ে চার লাখ টাকার ফান্ড সৃষ্টি করছেন। শুধু তাই নয়, বিভাগের নামে আদায় হওয়া এই টাকা খরচের কোনো জবাবদিহিও করতে হবে না চবির একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিন্ডিকেটের কাছে। কারণ সাংবাদিকতা বিভাগের অভ্যন্তরীণ আয় হিসেবে এই টাকা ব্যয় দেখাবেন বিভাগের সভাপতি নিজে। এই সংক্রান্ত আটটি ডকুমেন্ট চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে।

জানা গেছে, মাস্টার্সের ১৫ জন, চতুর্থ বর্ষের ১৪ জন, তৃতীয় বর্ষের ১৮ জন, দ্বিতীয় বর্ষের ২০ জন এবং প্রথম বর্ষের ১৬জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা ফির নামে বিভাগের সভাপতি টাকা আদায় করছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের কোথাও এভাবে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার নিয়ম নেই।

একাডেমিক কমিটির সভা কী বলছে?
সূত্র জানায়, গত ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ৩৯৫ তম একাডেমিক সভার আলোচ্যসূচি ছিল— ক্লাসে যাদের উপস্থিতির শতকরা হার ৬০ শতাংশের নিচে, পরীক্ষায় তাদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ওই সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ক্লাসে যাদের উপস্থিতির হার ৫৫ শতাংশের উপরে তারা নন-কলেজিয়েট শিক্ষার্থী হিসেবে ৬০০ টাকা জরিমানা প্রদান করে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। যাদের উপস্থিতির হার ৪০ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশ তারা বিভাগের ফান্ডে ৫ হাজার টাকা প্রদান করবে এবং যাদের উপস্থিতির হার ৩০ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ তারা বিভাগের ফান্ডে ৮ হাজার টাকা প্রদান করে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে।’

জানা গেছে, সাংবাদিকতা বিভাগের ওই একাডেমিক কমিটির সভায় প্রস্তাবটি তোলেন বিভাগীয় সভাপতি নিজে। সেদিন ৯ জন শিক্ষক উপস্থিত থাকলেও অনুপস্থিত ৪ জন শিক্ষক পরে এর বিপরীতে মতামত দেন, কিন্তু বিভাগের সভাপতি ওই মতামত গ্রহণ করছেন না। জানা গেছে, সভাপতি তার অনুগত সহকর্মীদের নিয়ে বৈঠকের শেষ এজেণ্ডা হিসেবে এটি পেশ করেন। দুজন শিক্ষক নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভায় অংশ নেওয়ার পরিবেশ নেই। ফলে পরবর্তীতে মতামত দিলেও বিভাগের সভাপতি তা কানে তোলেননি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কী বলছে?
দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এটি চলে ১৯৭৩ সালে প্রণীত অধ্যাদেশ অনুসারে। অধ্যাদেশে প্রদত্ত শিক্ষকদের ক্ষমতার কারণে রাষ্ট্র বা কোনো সংস্থা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ফলে চবির প্রভাবশালী শিক্ষকদের দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিচারও হয় খুব কম।অধ্যাদেশে কী বলা হয়েছে— এটি দেখতে গিয়ে ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৪৭২তম সভার ৫ নম্বর সিদ্ধান্ত (যা একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত চবি একাডেমিক কাউন্সিলের ২২২তম সভার সুপারিশের আলোকে গৃহীত) বিশ্লেষণ করা হয়। যেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়- ‘Students having less than 60% of class attendance will not be allowed to sit for the examination’। এর অনুমোদন দেন তৎকালীন রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ড. মোহাম্মদ সফিউল আলম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামহানি
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের একাডেমিক শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘জোর করে টাকা আদায়ের এমন ঘটনা আমাদের হতবাক করেছে। ৬০ শতাংশের নিচে উপস্থিতির হার যেসব শিক্ষার্থীর, তাদেরকে পরীক্ষায় বসার অবৈধ সুযোগ দিয়ে সভাপতি এটি গুরুতর অন্যায় করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় নিজের আইনেই চলবে। একজন বিভাগীয় সভাপতি নিজের প্রভাব খাটিয়ে এভাবে ফান্ড তৈরি করতে পারেন না। শিক্ষার্থীদের সাথে বিভাগ বা বিভাগের সভাপতি কোনভাবেই অর্থ লেনদেন করতে পারেন না। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামহানি ও বিধিবিরুদ্ধ কাজ।’

ওই কর্মকতা বলেন, ‘তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক লেনদেন হবে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক একাউন্টের মাধ্যমে। কোনো সংক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী, অভিভাবক বা যে কোনো নাগরিক হাইকোর্টে রিট করলে পরীক্ষার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে।’

বাণিজ্য চলছে যেভাবে
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১৭ আগস্ট থেকে একযোগে ৫টি শিক্ষাবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। ১০ আগস্ট শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণের শেষ সময়। জানা গেছে, মাস্টার্সের ১৫ জন, চতুর্থ বর্ষের ১৪ জন, তৃতীয় বর্ষের ১৮ জন, দ্বিতীয় বর্ষের ২০ জন এবং প্রথম বর্ষের ১৬ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা ফির নামে টাকা আদায় করা হচ্ছে।

এর মধ্যে মাস্টার্স শেষ বর্ষের ১১ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা করে ৫৫ হাজার টাকা এবং চার জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা করে ৩২ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। অনার্স চতুর্থ বর্ষের ১০ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা করে ৫০ হাজার টাকা এবং চারজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা করে ৩২ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। তৃতীয় বর্ষের ১৬ জন শিক্ষার্থীর নিকট ৫ হাজার টাকা করে ৮০ হাজার টাকা এবং একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। দ্বিতীয় বর্ষের ১৯ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা করে ৯৫ হাজার টাকা এবং একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। বাদ যায়নি নবাগত সম্মান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীও। এই শিক্ষাবর্ষের ১৫ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা করে ৪৫ হাজার টাকাও আদায় করা হয়েছে।

এভাবে ৫টি শিক্ষাবর্ষের ৮১ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জরিমানার নামে অবৈধভাবে আদায় করা হয়েছে চার লাখ ৫ হাজার টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, তারা আপিল করলেও বিভাগের সভাপতি সেটি কানে নেননি। এমনকি কয়েকজন শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার মুখে থাকলেও তাদেরকে পরীক্ষার সুযোগ দিচ্ছেন না। কিন্তু বিরাট অঙ্কের টাকা জরিমানা দিয়ে বাকিদের সুযোগ করে দিচ্ছেন।

খরচ হবে একজনের ইচ্ছায়
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় হিসাব নিয়ামক সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের নামে আদায় হওয়া এই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ফান্ডে যুক্ত হচ্ছে না। ফলে এটি বিভাগের সভাপতির নিজের মতো করে খরচ করার সুযোগ থাকছে।

বিভাগের সভাপতির বক্তব্য
৬০ শতাংশের নিচে উপস্থিত থাকা শিক্ষার্থীদের টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেয়া এবং অবৈধভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চার লাখ টাকা আদায়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিভাগের সভাপতি রওশন আকতার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো বিভাগের চেয়ারম্যান কি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখানে আমার কোন ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেই।’

চবির ৭৩ সালের অধ্যাদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যেটা বলেছি ওটাই অফিসিয়াল বক্তব্য। এর বাইরে আমি আর কিছু বলতে পারবো না।’

এই ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিভাগের সাবেক সভাপতি ড. শহীদুল হক বলেন, ‘আমার মা অসুস্থ, আমি হাসপাতালে। আপনি দয়া করে অন্য কোনো শিক্ষকের কমেন্ট নিন। আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছি না।’

সাংবাদিকতা বিভাগের ৮১ শিক্ষার্থীর বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিপন্থী কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বেনু কুমার দে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না, খবর নিয়ে দেখতে হবে। হয়তো মানবিক দিক বিবেচনা করে, অথবা কেউ দরিদ্র আছে তাই হয়ত অনুমতি দিয়েছে।’

জরিমানার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে তো জানি না। টাকা নিয়েছে তা জানা নেই। আমি বাইরে। আমি খবর নিচ্ছি।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!