সরকারি জায়গা দখলে নিয়ে পতেঙ্গায় ৪ বিএনপি নেতার ‘পিঠা ভাগ’

অবৈধ স্থাপনা থেকে বছরে আয় অর্ধকোটি টাকা

চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থানার ধুমপাড়া এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দশমিক ৬৫ একরের পরিত্যক্ত জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি বিএনপির সভাপতিসহ চার নেতা। ২০০৪ সাল থেকে এ জায়গায় শতাধিক ঘর-বাড়ি, দোকানপাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে তারা। জানা গেছে, প্রতিটি দোকান থেকে মাসিক ৫-৬ হাজার করে বছরে আদায় করা হচ্ছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পতেঙ্গা ধুমপাড়ার কাটগড় ও ফুলছড়ি পাড়া রোডে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জায়গায় দশমিক ৬৫ একর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে পতেঙ্গা রেঁনেসা কিন্ডারগার্টেন স্কুলসহ দুটি সামাজিক ক্লাব। ওই জায়গার গলির ভেতরে রয়েছে একটি তিনতলা ভবন। এছাড়া দীর্ঘ সারিতে রয়েছে দোকানপাট, সেমি পাকা ও কাঁচাঘরসহ শতাধিক স্থাপনা।

১০ বছর আগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সতর্কবাণী সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছিল।
১০ বছর আগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সতর্কবাণী সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছিল।

জানা গেছে, বিশাল এই জায়গার এক-তৃতীয়াংশ দখলে রেখেছেন পতেঙ্গা থানা ৪০ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. হারুন। তিনি ২০০৪ সাল থেকে ওই জায়গায় পতেঙ্গা রেনেসাঁ কিন্ডারগার্টেন কেজি স্কুলসহ ২০-২৫টি দোকানপাট ও স্থাপনা নির্মাণ করে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিয়েছেন। প্রতিটি দোকান থেকে মাসিক ভাড়া আদায় করা হয় ৫-৬ হাজার টাকা করে। শুধু তাই নয়, দখল করা ওই জায়গায় পুকুরের মধ্যে একটি একতলা ভবনের নির্মাণকাজও ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছেন তিনি।

আরও জানা গেছে, ওই জায়গার কিছু অংশ দখলে নিয়েছেন আরেক বিএনপি নেতা মো. ইমতিয়াজ। তার দখলে রয়েছে ধুমপাড়া এলাকার পূর্ব গলি থেকে জামালের পানির ট্যাংক পর্যন্ত অংশ। ইমতিয়াজের দখলেও রয়েছে ৩০-৪০টি টিনশেড দোকান ও ভাড়া ঘর। তিনিও এসব স্থাপনা ভাড়া দিয়ে মাসে আদায় করছেন লাখ টাকা। অন্যদিকে ধুমপাড়ার মূল সড়ক থেকে ওই জায়গার কিছু অংশ দখলে নিয়ে স্থাপনা করেছেন আরেক বিএনপি নেতা সাজ্জাত হোসেন। তিনিও ২০-২৫টি দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। তার আয়ও মাসে লাখ টাকা।

পতেঙ্গা থানা ৪০ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. হারুনের রেনেসাঁ কিন্ডারগার্টেন কেজি স্কুল।
পতেঙ্গা থানা ৪০ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. হারুনের রেনেসাঁ কিন্ডারগার্টেন কেজি স্কুল।

এছাড়া খোকন নামে স্থানীয় এক বিএনপি সমর্থক তার দখলে থাকা একটি তিনতলা ভবন ২০১৮ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে কর্মরত ছালেহ আহমদ নামে এক ব্যক্তির কাছে ‘কবলা মূলে’ বিক্রি করে দেন। ভবনটি বিক্রি হয় ৩১ লাখ টাকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০ বছর আগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই জায়গায় একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। সাইনবোর্ডে লেখা হয়—তফসিলভূক্ত দশমিক ৬৫ একরের জায়গার মালিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তফসিলভূক্ত ভূমিতে কোন প্রকার অনুপ্রবেশ, নির্মাণ, সংস্কার, পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তবে ওই জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের লাগানো সাইনবোর্ড কৌশলে ঢেকে ফেলেছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং ও স্থাপনায়।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সাবেক বন্দর বর্তমানে উত্তর পতেঙ্গা মৌজা তফশীলভূক্ত জমির মালিক দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দশমিক ৬৫ একরের জায়গার বিএস খতিয়ান নম্বর হল ৬। আরএস দাগ নম্বর ১০০৩১ ও বিএস দাগ নম্বর ৭৬৮৬। ওই জায়গাটিতে অধিদপ্তরের দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির অর্থায়নে একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়্যারহাউজ স্থাপন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

ইমতিয়াজ ও সাজ্জাতের দখল করা জায়গায় উঠেছে সেমি পাকা ও কাঁচাঘর।
ইমতিয়াজ ও সাজ্জাতের দখল করা জায়গায় উঠেছে সেমি পাকা ও কাঁচাঘর।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জায়গায় ভাড়াটে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ২০০৪ সাল থেকে তারা সেখানে ব্যবসা করছেন। ওই সময় প্রতিটি দোকান ৫০ হাজার টাকা সালামি নিয়ে ১৫ বর্গফুটের একেকটি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। ৫ বছর পর পর ভাড়ার কথিত চুক্তির মেয়াদ বাড়ায় দখলদাররা। বর্তমানে তিন ব্যক্তির দখলে থাকা জায়গায় পৃথকভাবে দোকান ও ঘর ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি দোকানে বর্তমানে সালামি হিসেবে নেওয়া হচ্ছে লাখ টাকা।

সরকারি জায়গা উচ্ছেদ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কয়েকজন দোকান মালিক জানান, ‘সরকার যদি এ জায়গা উচ্ছেদ করে তাহলে চলে যাব। দোকানের সালামির টাকা স্ট্যাম্পমূলে ফেরত নিয়ে নিব। না দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেবো।’

জায়গা দখলকারীদের অন্যতম বিএনপি নেতা মো. ইমতিয়াজ অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ধুমপাড়া এলাকায় দশমিক ৬৫ একরের জায়গাটি সরকারি খাসজমি। তাই দোকানপাট ও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সরকার চাইলে তা ছেড়ে দেবো।’

এভাবে দখলে নিয়ে বাণিজ্য করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি অবৈধ কাজ। খালি পড়ে ছিল, তাই দখল করে রেখেছি। আমি না করলেও অন্যজন ঠিকই দখল করত।’

পতেঙ্গা থানা ৪০ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. হারুনকে দখলের বিষয়ে জানতে তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া দেননি। এসএমএস পাঠিয়েও কোন জবাব মেলেনি।

চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দশমিক ৬৫ একরের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করে বাণিজ্য করা আইনগত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ জায়গা কোন রকম সংস্কারের প্রচেষ্টা ও দখল বাণিজ্য না করতে একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
শীঘ্রই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পতেঙ্গা এলাকার জায়গাটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের। এ জায়গা দখলের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!