নির্যাতিত সংখ্যালঘু মানুষের নীরব কান্নার প্রতিধ্বনি ‘গোলাকার পৃথিবীতে গোলাকার ঘটনাবৃত্ত’

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। জনবহুল এই দেশে মোট জনসংখ্যার কেবল সাড়ে আট শতাংশ হিন্দু। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও বিগত বছরগুলোতে দেশের নানান জায়গায় আমরা সাম্প্রদায়িকতার করাল গ্রাস দেখেছি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দায় দিয়ে এই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি, ধর্মীয় উপাসনালয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করার ঘটনা ঘটেছে। লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে বহু মানুষ।

এসব ঘটনার সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে কবি কুশল বরণ চক্রবর্ত্তীর ‘গোলাকার পৃথিবীতে গোলাকার ঘটনাবৃত্ত’ কাব্যগ্রন্থে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এমন নিন্দনীয় হামলার তীব্র দাহ, যন্ত্রণা, ক্ষোভ ও পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে কাব্যগ্রন্থে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক কুশল বরণ চক্রবর্ত্তীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘গোলাকার পৃথিবীতে গোলাকার ঘটনাবৃত্ত’। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নারকীয় হামলার পটভূমিকে কেন্দ্র করে ৩৭ টি স্বতন্ত্র কবিতার সমন্বয় হলো এই কাব্যগ্রন্থ।

এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘গোলাকার পৃথিবীতে গোলাকার ঘটনাবৃত্ত’, এর নাম অনুসারেই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে। এই কবিতায় কবি কুশল বরণ চক্রবর্তী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। কীভাবে বিভিন্ন গুজব বা প্রপাগান্ডার ওপর ভিত্তি করে শুক্রবারে জুমায় গণজমায়েতকে পুঁজি করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করা হয়, তা এই কবিতার প্রথম ভাগে চিত্রায়িত করা হয়েছে। যাকে এই কবিতায় কবি নীলনকশার স্ক্রিপ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। কবিতায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাতে লাগানো আগুনে ঠাকুমার একমাত্র সম্বল মৃত দাদুর ছবিটিও পুড়ে যাওয়ার ঘটনাটি মর্মস্পর্শী। কবি কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী লিখেছেন—

হে ভগবান বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও!
ঘরে আগুন, মন্দিরে আগুন
আমার সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল রে
ঠাকুমার একমাত্র সম্বল
মৃত দাদুর ছবিটি
তা-ও পুড়ে শেষ; সব পুড়ে ছাই।
হে ভগবান, বাঁচাও! বাঁচাও!

‘গোলাকার পৃথিবীতে গোলাকার ঘটনাবৃত্ত’ কবিতায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ভয়াবহতার পাশাপাশি এসব ঘটনায় প্রশাসনসহ অন্যান্য দায়িত্বশীল মহলের নিরবতার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

এছাড়া হামলার পর বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতাদের লোক দেখানো সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধনে অংশগ্রহণ, ফেসবুক লাইভসহ বিভিন্ন জায়গায় তাদের বক্তব্যের ফুলঝুরির কথা কবিতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

তবে কবিতার শেষাংশে আশার বাণীও তুলে ধরেছেন কবি কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী। বার বার পুনরাবৃত্ত হওয়া এমন অসাম্য, হিংসা ও অমানবিকতার গোলাকার ঘটনাবৃত্ত একদিন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। রাত পেরুলে উদিত হবে নতুন এক সূর্য, তাতে রচিত হবে নতুন এক সম্প্রীতির ইতিহাস। কবির ভাষায়—

কালবিভাবরী অন্তে,
এক নতুন সূর্যোদয়
এক নতুন সম্প্রীতির ইতিহাস।

মৌলবাদীরা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের কারণ হিসেবে প্রতিবারই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দিকেই আঙুল তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব বা বিভিন্ন প্রপাগান্ডাতে কোনো ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই সহজেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে দেশের এক শ্রেণির মৌলবাদী চক্রের। এমন ঠুনকো অনুভূতি্র প্রতি অত্যন্ত বিরক্তি ও ক্ষোভ ঝেরেছেন কবি কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী। তিনি তার ‘গোলাকার পৃথিবীতে গোলাকার ঘটনাবৃত্ত’ কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় এমন অনুভূতির বিষয়ে হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।

‘অনুভূতির বাণিজ্য’ কবিতায় এমন অনুভূতিকে রূপক অর্থে তুলার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মৌলবাদীরা যে এই দেশকে গ্রাস করছে, তাকে কবি তুলার বাম্পার ফলন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কাব্যগ্রন্থের অন্যান্য কবিতায় অনুভূতিকে বিদ্রুপের সঙ্গে ‘নুভূতি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এছাড়া ‘নুভূতি’ নামে একটি স্বতন্ত্র কবিতাও রয়েছে কাব্যগ্রন্থে।

কাব্যগ্রন্থে ‘অন্ধ অনুভূতির দোহাই’ কবিতায় অন্ধবিশ্বাসী ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পধারীদেরকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাদেরকে কবি কোনো ধরনের পশুর সঙ্গে তুলনা করতেও নারাজ। কারণ বিভিন্ন গুণাবলীতে পশুও এসব মানুষের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে বলে কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী মনে করেন। তাই তাদের মহাউন্মাদ ও মহামূর্খ বলে অভিহিত করেছেন তিনি।

কাব্যগ্রন্থের ‘অনুভূতি না ছাই’ কবিতায় কুশল বরণ চক্রবর্তী এমন ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সন্দেহ পোষণ করেছেন। কবিতায় কবি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যদি সংখ্যালঘুদের ওপর এসব হামলা শুধুই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে অসহায় মানুষের সহায়-সম্বল, গবাদি পশু বা অন্যান্য দামি জিনিসপত্র কেন লুটপাট হবে?’

‘যদি হামলাকারীরা সত্যি ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের কারণে হামলা চালিয়ে থাকে, তাহলে পরনারীদের প্রতি তাদের কুদৃষ্টি পড়ে কিভাবে? তাই কবি কুশল বরণ চক্রবর্তী ‘অনুভূতি না ছাই’ কবিতায় লিখেছেন—

মুখে মুখেই অনুভূতি
মগজে থাকে অন্যের
সহায় সম্পদ দখলের
নেশাময় বিকৃত সুখানুভূতি।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘গোলাকার পৃথিবীতে গোলাকার ঘটনাবৃত্ত’-তে কেবল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকারী ধর্মীয় মৌলবাদ চক্রের বিষোদগার করেছেন তা নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুবিধাবাদী নেতাদের প্রতিও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। কাব্যগ্রন্থের ‘একটি ধর্মীয় অনুভূতির গল্প’ কবিতায় তিনি গল্পের ছলে একটি সুনিপুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। মঞ্চে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাপুটে বক্তব্য দেওয়া নেতার আসল রূপ বা চরিত্র এই কবিতায় সুস্পষ্টভাবে তোলে ধরা হয়েছে। নেতার সামনে হঠাৎ ভীতসন্ত্রস্ত এক ছেলে এসে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দায়ে তাদের বাড়িতে হামলা ও লুটপাটসহ তার দিদিকে পাশবিক নির্যাতনের কথা জানায়। তাতেই বেরিয়ে আসে এসব মুখোশধারী নেতার আসল রূপ। মঞ্চে সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের প্রতিরোধের কথা বললেও সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার অসহায় ভীতসন্ত্রস্ত ছেলেটিকে এটা তাদের ব্যক্তিগত ঝামেলা না হলে হামলাকারীদের ‘দেখে নিতো’ বলায় নেতার ছলচাতুরী রূপের প্রকাশ পেয়েছে। এভাবে সুবিধাবাদী ও মুখোশধারী এসব নেতার আচরণের সুস্পষ্ট চিত্র ‘একটি ধর্মীয় অনুভূতির গল্প’ কবিতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

এদিকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার পর হামলাকারীদের নিয়ে এই সম্প্রদায়েরই এক শ্রেণির মানুষের দ্বিধান্বিত অবস্থানের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে কাব্যগ্রন্থের ‘অবহেলার ধুলা ঝেরে’ কবিতায়। কবিতায় এসব মানুষকে নির্বোধ, গর্দভ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কবির ভাষায়, এসব ‘নির্বোধ গর্দভ’ এর মধ্যে হামলা নিয়ে জ্ঞানগম্যি তর্ক চলে। এদের মধ্যে একদল মনে করে হামলাকারীরা চিহ্নিত মৌলবাদী, জ্ঞানীর বেশধারী আরেকদল মনে করে চিহ্নিত মৌলবাদীরা না, বরং প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পড়া ছদ্মবেশী মৌলবাদীরাই হামলাকারী। এই দলভুক্তরা এসব হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রেরও ঘ্রাণ পায়।

কবির মতে, সংখ্যালঘু হিন্দুদের মন্দির প্রকৃত মৌলবাদীরা ধ্বংস করেছে নাকি ধর্মনিরপেক্ষ মৌলবাদীরা ধ্বংস করেছে, এনিয়ে কথার ফুলঝুরি না করে বরং দেবতার মূর্তি ধ্বংস করে এতদিনের বিশ্বাসকে যে অবহেলার ধুলায় ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে, সেদিকেই তাকানো দরকার।

অবহেলার ধুলা ঝেরে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এই দুই শ্রেণির মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কবি কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী।

কাব্যগ্রন্থে হাটহাজারী, রামু, সাঁথিয়া, নাছিরনগর, গঙ্গাচড়া বা সিলেটের শাল্লা এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত হামলার দৃশ্যপট ও ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর পাশাপাশি এই কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় দেশের সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগী বীর শহীদ, রাজাকারের দল ও দেশের দুর্বল গণতন্ত্রের পাশাপাশি দেশ প্রেমের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া কাব্যগ্রন্থের শেষের দিকে হতাশা ছাড়িয়ে, অনিয়মের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে সবার প্রতি সামনে এগিয়ে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করা হয়েছে।

জেএন/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!