তিন মাসেই দণ্ডিত আসামির ‘বিস্ময়কর’ জামিন ২০ লাখ পিস ইয়াবার মামলায়

চট্টগ্রামে গভীর সাগরে এক মাছ ধরার ট্রলার থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল ২০ লাখ পিস ইয়াবা। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১১ আসামি বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান। কিন্তু সাজার রায় ঘোষণার তিন মাসের মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান দণ্ডিত এক আসামি। জামিন পাওয়ার এমন ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষ ওই আসামির কারামুক্তি ঠেকাতে যায় আপিল বিভাগে। আর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত আলোচিত এই মামলার আসামির জামিন ২৭ মার্চ পর্যন্ত স্থগিতের আদেশ দিয়েছেন।

২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল ভোরে চট্টগ্রামে গভীর সাগরে একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে ২০ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব-৭। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় বেশ কয়েকজনকে। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পতেঙ্গা মডেল থানায় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯(১) এর ৯(খ)/২১/২৫ ধারায় এ নিয়ে মামলা করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, উদ্ধার করা ২০ লাখ পিস ইয়াবার ওজন ২০০ কেজি— যার বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

পরে তদন্ত শেষে দাখিল করা চার্জশিট আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয় আদালতে। সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও আত্মপক্ষ সমর্থন শেষে ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ চতুর্থ আদালতের বিচারক শরিফুল আলম ভুঁইয়া।

ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ২০ লাখ পিস ইয়াবার এত বড় চালান জব্দের ঘটনা বাংলাদেশে বিরল। যেসব আসামি ঘটনাস্থল থেকে আটক হয়েছে তারা সবাই মজুর শ্রেণির। কিন্তু তাদের প্রকৃত দখল ও নিয়ন্ত্রণে ইয়াবাগুলো ছিল। আসামিদের জবানবন্দিতে ঘটনাপ্রবাহ এবং ফিশিং বোটে করে ইয়াবা পরিবহনের কথা প্রকাশ করেছে, তার সঙ্গে এজাহারকারীসহ অন্যান্য সাক্ষীদের বক্তব্য, জব্দতালিকার বিষয়বস্তুর সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। আসামিদের জবানবন্দি সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। এ কারণে আসামি নূরুল মোস্তফাসহ আট আসামিকে ১৫ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন বিচারক। এছাড়া মোজাহেরসহ তিন আসামিকে ৫ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যদিকে খালাস দেওয়া হয় ৬ আসামিকে।

ধরাছোঁয়ার বাইরে ট্রলারমালিক

মামলাটির তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন আদালত। বিস্ময় প্রকাশ করে আদালত বলেন, যে ট্রলারটি থেকে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে সেই ট্রলারের মালিককেই অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়নি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইজিপির দৃষ্টিও আকর্ষণ করেন আদালত। মামলাটির তদন্তে ছিলেন পতেঙ্গা থানার তৎকালীন পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ফৌজুল আজিম, র‌্যাব-৭ এর তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. জালাল উদ্দীন আহম্মদ এবং পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দীন।

আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ২০ লাখ ইয়াবার চালান যে ট্রলার থেকে জব্দ করা হয়েছে, সেই ট্রলারের মালিক এই ঘৃণ্য অপরাধের দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তিনজন তদন্ত কর্মকর্তার কেউই এই বিপুল পরিমাণ মাদক সরবরাহকারী ফিশিং বোটটির মালিক নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেননি অথবা অভিযোগপত্রে নীরব থেকেছেন। এই চালান ফিশিং ট্রলারের মালিকের জ্ঞানের বাইরে হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন আদালত।

মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে ট্রলারের মালিক হিসেবে আব্দুল জলিলের নাম উল্লেখ থাকলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়, সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতর থেকে ইস্যু করা লাইসেন্সে ট্রলারটির মালিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে— নেজাম উদ্দিন।

তিন মাসেই জামিন

রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন কারাগারে থাকা আসামিরা। হাইকোর্ট শুনানির জন্য আপিল গ্রহণ করেন। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে আসামি নুরুল মোস্তফা জামিন চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ আসামি নুরুল মোস্তফার জামিন মঞ্জুর করেন। এই জামিন স্থগিত চেয়ে দ্রুতই আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম জামিন সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ ২৭ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে দেন।

আসামির জবানবন্দি

মামলায় গ্রেফতারকৃত ৬ আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাদের সকলের জবানবন্দি একই ধরনের। সেই জবানবন্দিতে মামলার অন্যতম আসামি মো. নুরুল মোস্তফা বলেন, ‘আমি দিনমজুর। যে কাজ করতে বলে আমি তাই করি। কিছুদিন আগে নাসির মাঝি তার সঙ্গে বোটে করে সাগরে মাছ ধরার জন্য যেতে বলে। আমি তার কথায় রাজি হই। আমরা সবাই চট্টগ্রামের ফিশারিঘাট হতে বোটে উঠি। এরপর আমরা গভীর সাগরের বিভিন্ন জায়গায় জাল ফেলে মাছ ধরি। মাছ ধরতে ধরতে সেন্টমার্টিনের কাছে চলে আসি। সেন্টমার্টিনের কাছে আসার পর আমাদের সঙ্গে থাকা মকতুল হোসেন কাকে যেন ফোন দেয়।’

জবানবন্দিতে নুরুল মোস্তফা আরও বলেন, ‘ফোনের কিছু সময় পরে ৩-৪ জন লোক বার্মার দিক হতে বোট নিয়ে আমাদের বোটের কাছে আসে। এরপর তার লোকজন ১০টি বস্তা আমাদের বোটে তুলে দিয়ে চলে যায়। এগুলো কিসের বস্তা ছিল তা আমি জানতাম না। এরপর মকতুল আমাদের নিয়ে সেন্টমার্টিন হতে চট্টগ্রামের দিকে রওয়ানা দেয়। আমরা পতেঙ্গা আসার পর মকতুল ফোন দিয়ে মোজাহেরকে পতেঙ্গা আসার কথা জানায়। পতেঙ্গা আসার কিছু সময় পর র‌্যাব এর লোকজন আমাদের বোটটিকে আটক করে এবং আমাদের বোটে থাকা ১০টি বস্তা ও আমাদেরকে নিয়ে র‌্যাব অফিসে আসে। পরে মকতুলের মাধ্যমে জানতে পারি যে এ বস্তাগুলোর মূল মালিক হল মোজাহের, আব্দুন নূর ও জলিল।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!