চবি অফিসার সমিতিতে অস্থিরতা, সেক্রেটারির বিরুদ্ধে রেজিস্ট্রারকে চিঠির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) অফিসার সমিতির সাধারণ সম্পাদকের উপর ‘বেজায় চটেছে’ সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি। সম্প্রতি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি পদে মনোনীত হন সমিতির সাধারণ সম্পাদক হামিদ হাসান নোমানী। ফেডারেশনের কমিটি গঠন প্রক্রিয়াকে নিয়মবহির্ভূত দাবি করে কেন্দ্রীয় এই সংগঠনের যেকোনো কার্যক্রম থেকে নোমানীকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে চবি অফিসার সমিতি।

সমিতিকে ঘিরে কার্যনির্বাহী কমিটির ভেতরে তৈরি হওয়া দীর্ঘদিনের কোন্দল এই ইস্যুতে প্রকাশ্যে রূপ নিলো। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তাদের একমাত্র সংগঠনটিতে শুরু হয়েছে অস্থিরতা।

এই কোন্দলের নেপথ্যে কি রয়েছে তা নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে চলছে গুঞ্জন। একপক্ষ বলছে, অফিসার সমিতির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ নিয়োগ-তদবির নিয়ে। ইতোমধ্যে প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে কেউ নিয়েছে ভাইপো’র চাকরি, কেউ নিয়েছেন ভাগ্নি জামাইয়ের চাকরি। আবার কেউ কেউ বলছে, অফিসার সমিতিকে তারা ব্যবহার করছে আধিপত্যের ঢাল হিসেবে। নিজের পক্ষে থাকা কর্মকর্তাকে সুবিধাজনক স্থানে বদলী করাতে তৎপর থাকেন তারা। আর অপছন্দের ব্যক্তিদের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাজনক দায়িত্বে বদলী করাতে তৎপর থাকেন কয়েকজন সমিতির কয়েকজন পদধারী।

এদিকে দ্বন্দ্বের নেপথ্যে কেউ কেউ বলছেন, সামনে অফিসার সমিতির নির্বাচন। আগামী কার্যকরী পরিষদের নির্বাচনী সমীকরণ মেলাতে গিয়ে বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দীর্ঘদিনের ‘জোটে চিড়’ ধরেছে।

এছাড়া অফিসার সমিতির নেতাদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তারা স্বেচ্ছাচারী এবং তাদের টার্গেট আত্মীয়স্বজনের চাকরি। কার্যকরী পরিষদের সকল সদস্য নয়, দুই-তিন জন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেই উঠেছে এমন অভিযোগ।

জানা গেছে, চবি অফিসার সমিতির জাবেদ-নোমানী পরিষদ বর্তমান মেয়াদসহ টানা দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছে। প্রথম মেয়াদে কর্মচারী সমিতির সঙ্গে অফিসার সমিতি যৌথ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে ‘ডিউ ডেট’ চালু রাখা ও বেতন স্কেল বৈষম্য দূর করতে অফিসার সমিতির দুই নেতাও ভূমিকা রেখে প্রশংসিত হয়েছিল। এই ভূমিকাই তাদের নির্বাচনী পার করতে সহযোগিতা করে। কিন্তু ২০২২-২০২৩ কার্যকরী পরিষদের দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তারা জন্ম দেয় বিতর্কের।

বর্তমানে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়েই সম্প্রতি অফিসার সমিতির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে।

এই দ্বন্দ্ব আরও জোড়ালো হয় সম্প্রতি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারশনে সভাপতি রশীদুল হায়দার জাবেদকে ডিঙিয়ে সাধারণ সম্পাদক হামিদ হাসান নোমানী সিনিয়র সহ সভাপতি পদে মনোনীত হলে।

এর পরপরই সমিতির কার্যকরী পরিষদের সভায় আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার সমিতি ফেডারেশনের পদ নিয়ে সমিতির সাধারণ সম্পাদকের উপর ‘চটে’ কার্যনির্বাহী কমিটি। এ সভার পর সংগঠনের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারকে সমিতির পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে আরেক ‘গল্পের’ জন্ম দেয় অফিসার সমিতি।

রেজিস্ট্রারের এখতিয়ারে না থাকলেও সমিতির সাধারণ সম্পাদকের ফেডারেশনে পদ নেওয়াকে কেন্দ্র করে ‘যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার’ চিঠি দেওয়াকে অপ্রাসঙ্গিক বলেই মনে করছে সমিতির সাধারণ সদস্যরা।

জানা গেছে, গত ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার সমিতির কার্যকরী পরিষদের জরুরি সভা আহবান করা হয়। সভার এজেন্ডা ছিল সাধারণ সম্পাদক হামিদ হাসান নোমানীর আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারেশনের সহ সভাপতি পদে নিযুক্তি নিয়ে।

এই সভা থেকে নোমানীকে অফিসার্স ফেডারেশনের কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারকে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে চিঠি দেয় অফিসার সমিতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার সমিতির সেক্রেটারি পদে থাকা অবস্থায় সহ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবু জাফর ইকবাল আসিফ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে রেজিস্ট্রারকে এ বিষয়ে ‘যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ’ জানানো হয়। ওই চিঠিটির মাধ্যম হন অফিসার সমিতির সভাপতি রশীদুল হায়দার এ জাবেদ। অথচ অফিসার সমিতির আভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের অফিসিয়াল কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ চিঠি নিয়ে অফিসার সমিতির সাধারণ সদস্যদের মধ্যে ‘হাস্যরস’ তৈরি হয়েছে। সমিতির সভাপতির উপস্থিতিতে হওয়া সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে চিঠি সভাপতিকে মাধ্যম করেই রেজিস্ট্রারের কাছে প্রেরণের বিষয়টি নিয়েও চলছে সমালোচনা।

সাধারণ সদস্যের অনেকেই বলছেন, অফিসার্স ফেডারশনের বিষয়ে রেজিস্ট্রারের করণীয় কিছুই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, বিধিমালা যে অফিসাররা নিয়মিত প্রয়োগ করে থাকেন সে অফিসারদের নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে এমন চিঠি অপ্রত্যাশিত।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চবি অফিসার সমিতির সাধারণ সদস্য ও কর্মচারী সমিতির সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এটি একটি অস্পষ্ট ও ত্রুটিপূর্ণ চিঠি। আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারেশন সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগ কিংবা মতামত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারেশনের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পর্ষদ বরাবর দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারেশনে চ.বি. অফিসার সমিতির সম্পৃক্ত থাকা না থাকার বিষয়টি একান্তই অফিসার সমিতির। বিষয়টি চবি রেজিস্ট্রার মহোদয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত। নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমন হাস্যকর ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে চবি অফিসার সমিতির ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, কিছুদিন আগে অফিসার সমিতির এই কার্যকরী কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে কর্মচারীর ছেলে আখ্যা দিয়ে হেয়প্রতিপন্ন করে বিবৃতি দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেয়। যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চরম মর্যাদাহানি করে তারা। কারণ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ শতাংশ অফিসার প্রথমে কর্মচারী হয়ে যোগদান করে, পরে পদোন্নতির মাধ্যমে কর্মকর্তা হয়েছে। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্যও হয় কর্মকর্তা সমিতি।

এই বিষয়ে চবি অফিসার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হামিদ হাসান নোমানী বলেন, ‘আমি মনে করি এটি তারা করতে পারেন না। সভাপতি ও সহ সাধারণ সম্পাদক হয়তো মনে করছেন, যে আগামীতে আমি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এ কাজ করেছে। এছাড়া ওই মিটিংয়ে উপস্থিত একাধিক সদস্যের কাছে আমি জিজ্ঞেস করেছি, আমাকে সমিতি থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তে তারা স্বাক্ষর করেছেন কি-না। তারা আমাকে জানিয়েছেন, তারা শুধু মিটিংয়ে উপস্থিতির স্বাক্ষর করেছেন। কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে স্বাক্ষর করেননি।’

এই বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে চবি অফিসার সমিতির সভাপতি রশীদুল হায়দার জাবেদের মুঠোফোন বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!