চট্টগ্রাম যুবলীগের কালক্ষেপণে কেন্দ্রে বাড়ছে ক্ষোভ, হার্ডলাইনে চেয়ারম্যান

সম্মেলনের জন্য চার মাস সময় চায় নগর কমিটি

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে দুই আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে চলা চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের কমিটি যখন সম্মেলন আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ‘হচ্ছে, হবে-তে’ ব্র্যাকেটবন্দি। কেন্দ্র থেকে বারবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও বিশেষ করে গত ছয় বছর ধরে আগের কমিটির ধারাবাহিক পথেই হেঁটেছেন মহিউদ্দিন বাচ্চু কমিটিও। নগরীর পাঁচটি ওয়ার্ড কমিটি ছাড়া কোনও কমিটি গঠন ছাড়া তারা ব্যর্থ হয়েছেন মহানগর কমিটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে।

তাই এবার চূড়ান্ত হার্ডলাইনে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। চলতি সেপ্টেম্বরের মধ্যেই যদি ৪৩টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডের সম্মেলন করে কাউন্সিলর তালিকা কেন্দ্রে জমা দিতে না পারে তাহলে অক্টোবরেই ভেঙে দেওয়া হবে নগর যুবলীগের বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি। নতুন আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে ওয়ার্ড সম্মেলন করে কাউন্সিলরের মাধ্যমে সম্মেলন করে নগর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

তবে গত ছয় বছরেও সম্মেলনে ব্যর্থ হওয়া মহিউদ্দিন বাচ্চু কমিটি সম্মেলনের জন্য কেন্দ্র থেকে চার মাসের সময় চেয়ে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু সেই সময় দিতেও রাজি নন যুবলীগ চেয়ারম্যান। তার বক্তব্য, যারা গত ছয় বছরে সম্মেলন করার সামর্থ্য রাখে না, তাদের চার মাস নয় চার দিনও সময় দেওয়া অনুচিত। তৃণমূলে প্রাণসঞ্চারে কীভাবে সম্মেলন আর কমিটি করতে হয় তার ফর্মূলাও জানা আছে বলে জানান যুবলীগের শীর্ষ এ নেতার।

তবে অতীত অভিজ্ঞতায় এবারের তৎপরতায়ও এক মাসের মধ্যে কাউন্সিলর তালিকা তৈরি করে অক্টোবরেই কমিটি গঠন করা সম্ভব কিনা তা এখন দেখার বিষয়। অনেকেই বলছেন অনিশ্চিতা থাকলে যুবলীগের চেয়ারম্যানের কঠোর এ মনোভাব বজায় থাকলে তা সম্ভব হতে পারে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরসহ সারা দেশ থেকে যুবলীগের দশ ইউনিটকে ঢাকায় ঢেকে পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় কমিটি। সেই সময় সাংগঠনিক অবস্থার পাশাপাশি কমিটি গঠন ও কাউন্সিলরদের প্রস্তুতি নেওয়ার তাড়া দেওয়া হয়েছিল। সেখানে নগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির শীর্ষ পাঁচ নেতাই সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্য সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু যুবলীগ চেয়ারম্যান মালেয়শিয়া থাকায় চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত না এলেও তিনি দেশে এসেই জানিয়ে দিয়েছেন চলতি মাসের (সেপ্টেম্বর) কাউন্সিলরদের তালিকা কেন্দ্রে জমা দিয়ে আগামী অক্টোবরেই সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করার। এসব কমিটি গঠন বা কাউন্সিলরের তালিকা তৈরির সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আলতাফ হোসেন বাচ্চুকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে।

নেতাকর্মীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়ায় যুবলীগের তৃণমূলে হতাশা বিরাজ করছে। নেতৃত্বজট লেগে গেছে যুবলীগে। শত শত ছাত্র নেতা যুবলীগের কমিটিতে আসার জন্য মুখিয়ে আছে। কিন্তু দীর্ঘ ১৬ বছরেও কমিটি গঠন হচ্ছে হবে বলে তা কখনও আলোর মুখ দেখছে না। এ নিয়ে কেন্দ্র থেকে বারবার উদ্যোগ নিলেও নানা কারণে তা বারবারই ভেস্তে গেছে।

নগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও চসিক কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ‘দীর্ঘ বছর ধরে নগর যুবলীগের সম্মেলন তথা কমিটির জন্য হাজারো যুব নেতারা মুখিয়ে আছে। কেন্দ্র থেকে বারবার বলার পরও বর্তমান কমিটি তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাবেক ছাত্রনেতারা তো স্বাভাবিকভাবেই যুবলীগের নেতৃত্বে আসবে। এভাবে যুবলীগের নেতারা আওয়ামী লীগে যাবে। এভাবেই নেতৃত্ব বিকশিত হবে, সংগঠন গতিশীল হবে। কিন্তু দীর্ঘ বছর কমিটি না হওয়ায় নেতৃত্বজট তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি তৃনমূলে হতাশাও দেখা দিয়েছে।’

তৃণমূলে কাজ করা সাবেক ছাত্রনেতা সাহেদ হোসেন টিটু বলেন, ‘ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে সরে দীর্ঘদিন ধরে যুবলীগকে সংগঠিত করছি। কিন্তু কমিটি না হওয়ায় কোন পদ-পদবি নেই দেখে নেতাকর্মীদের কাছেও বিব্রত হচ্ছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে আমার মত হাজারো যুবলীগের সংগঠকের প্রাণের দাবিটা মেনে নিয়ে কমিটি গঠন করা হবে।’

এ প্রসঙ্গে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘তৃণমূলের প্রাণ সঞ্চারে সাংগঠনিক গতি আনতে এ মাসেই কাউন্সিলরদের তালিকা জমা দিতে বলেছি। অক্টোবরেই সম্মেলন করা হবে নগর যুবলীগের। ইতোমধ্যে আলতাফ হোসেন বাচ্চুকে বিষয়টি সমন্বয় করতে দায়িত্ব দিয়েছি।’

তবে নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাউন্সিলর তালিকা জমা দিতে বলা হয়েছে। এর পরের মাস অক্টোবরেই সম্মেলনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ৪৩টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডের মধ্যে পাঁচটি মাত্র কমিটি আছে। এর মধ্যে একজন আহ্বায়ক মারা গেছেন। সে হিসাবে ৩৮টি ওয়ার্ড কমিটি এতো দ্রুত সময়ের ম্যধ্যে কীভাবে হবে তা বোধগম্য নয়। এরপরও আমারা কোন মেথডে তা করব কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত জানতে চাই। কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা আসবে সেভাবে কাজ করা হবে।’

নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের আগের আহ্বায়ক কমিটিও তাদের দশ বছর মেয়াদে ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে পারেনি। আমরাও নানা কারণে পারিনি। তাই কেন্দ্রের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ৩৮টি ওয়ার্ডের সম্মেলন করা অসম্ভব। এছাড়া নানা গ্রুপিংয়ের কারণেও কাউন্সিলরদের তালিকা তৈরিও ডিফিকাল্ট। তাই কেন্দ্রের কাছে আমরা চার মাসের সময় চেয়ে একটি চিঠি দিয়েছি। এখনো জবাব পাইনি।’

সময়ের আবেদনের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘একটা সম্মেলন করতে নানা প্রস্তুতি থাকে—অতিথিদের দাওয়াত দেওয়া, কনফার্ম করা। মঞ্চ প্যান্ডেল খাবার সব আয়োজনই করতে হয়। এসব করতে কমপক্ষে এক ওয়ার্ডে পাঁচ দিন লাগবে। আমরা প্রতিদিন একটি করে ওয়ার্ডে সম্মেলন করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই কেন্দ্রের কাছে এই চার মাস সময়ের আবেদন করেছি। কেননা আমরাও চাই শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবমূখর পরিবেশে নগর যুবলীগের সম্মেলন হোক। নতুন নেতৃত্ব উঠে আসুক।’

তবে এসব কথা মানতে নারাজ যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কোনও সময়-টময় আর দেবো না। এসব কাহিনী শুরু করলে একদম কমিটিই ভেঙে দেবো। নতুন আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে তাদের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘যারা গত ছয় বছরে ওয়ার্ড কমিটি গঠনের মাধ্যমে কাউন্সিলর তালিকা তৈরি করার সামর্থ রাখে না তাদের চার মাস নয় চার দিনও সময় দেওয়া হবে না। কমিটি ও কাউন্সিলর তালিকা কীভাবে করতে হয় তা আমি জানি। সেটা গত ৩০ বছর ধরে কমিটি না হওয়া সিলেট যুবলীগের কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে আমি দেখিয়ে দিয়েছি।’

যুবলীগ চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘স্থানীয় এমপি, মেয়র ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে আলাপ করে এবং বাচ্চুর (আলতাফ হোসেন বাচ্চু) সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিটি ওয়ার্ডে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হবে। সেই কমিটির ২৫ জন কাউন্সিলর হিসেবে নগর কমিটিতে ভোট দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। যারা এতো বছর ধরে কাজ করছেন। বিশেষ করে সাবেক ছাত্রনেতারা, কারা দলের জন্য কাজ করছে তা তো স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, বিশেষ করে সিটি মেয়র ও স্থানীয় এমপিরা তো অবগত আছেন। তাদের পরামর্শ নিয়েই দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব ওয়ার্ড়ের কাউন্সিলর তালিকা তৈরি করতে হবে এ মাসেই।’

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে কেন্দ্র থেকে নগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটিতে মহিউদ্দিন বাচ্চুকে আহ্বায়ক করে তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশনা ছিল। তবে ছয় বছর পার হলেও কমিটি করতে পারেনি আহ্বায়ক কমিটি। ১০১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির অনেক নেতা আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। গঠনতন্ত অনুযায়ী তিন বছর আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয় এই কমিটির।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!