চট্টগ্রামে হঠাৎ টাইফয়েডের হানা, চিকিৎসা নিতে দেরী হওয়ায় বাড়ছে ধকল

চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ হাজিপাড়ার বাসিন্দা রাহুল (২৫) জ্বর নিয়ে গত ২০ জুলাই ভর্তি হন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। জ্বর ওঠার চতুর্থদিন তাকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়। কিন্তু পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়েনি। পরে করোনা পরীক্ষা করানো হলে তার রিপোর্টও নেগেটিভ আসে। এরমধ্যে রাহুল দুর্বল হয়ে পড়ে। সঙ্গে দেখা দেয় পেটে ব্যথা ও পায়খানা। এই অবস্থায় ডাক্তার তাকে টাইফয়েড পরীক্ষা করতে দেন। পরীক্ষার রিপোর্টে তার ‘প্যারাটাইফয়েড’ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

রাহুলের মতো বেশ কয়েকজন রোগী ডেঙ্গু সন্দেহে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হলেও তারা মূলত টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছেন।

চট্টগ্রামের ডেঙ্গুর সঙ্গে নিরবে বাড়ছে টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগী। জ্বর উঠলেই অনেকে টাইফয়েডের চিন্তা বাদ দিয়ে আগে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাচ্ছেন। এতে দেরিতে শনাক্ত হচ্ছে রোগ। সেই সঙ্গে শনাক্তের পর অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া রোগী ধকল সহ্য করতে পারছে না। ডেঙ্গু রোগীর ফাঁকে প্রায়ই টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৬-৭ জন টাইফয়েডের রোগী আসছে বলে জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, সাধারণত রোগ-জীবাণু শরীরে প্রবেশের ১০ থেকে ১৪ দিন পর টাইফয়েডের লক্ষণ দেখা দেয়। জ্বর এই রোগের প্রধান লক্ষণ, যা প্রথম চার-পাঁচদিন কখনও বাড়ে আবার কখনও কমে। তবে কোনোসময় সম্পূর্ণ ছেড়ে যায় না। এর মধ্যে ১০৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা পর্যন্ত টানা জ্বর হওয়া, সঙ্গে মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা হওয়াসহ কারও কারও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও বমি, কফ বা কাশি হতে পারে।

জানা গেছে, টাইফয়েড জ্বর ‘স্যালমোনেলা টাইফি’ নামের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে এই জীবাণু ছড়ায়। তখন জ্বরসহ নানান ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তস্রোত ও অন্ত্রনালীতে এই ব্যাকটেরিয়া অবস্থান করে এবং দূষিত খাবার ও পানি গ্রহণের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করা জীবাণু।

আরও জানা গেছে, টাইফয়েড দু’ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে হয়ে থাকে—‘সালমোনেলা টাইফি’ ও ‘সালমোনেলা প্যারাটাইফি’। সালমোনেলা টাইফির সংক্রমণে যে জ্বর হয় তাকে টাইফয়েড জ্বর বা ‘এন্টারিক ফিভার’ বলে। আর যদি জ্বর সালমোনেলা প্যারাটাইফি জীবাণুর কারণে হয় তখন তাকে ‘প্যারা টাইফয়েড’ জ্বর বলে। তবে টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসা না নিলে জ্বর সপ্তাহ বা মাসব্যাপী থাকতে পারে। ডেঙ্গু আর টাইফয়েডের চিকিৎসা ভিন্ন, টাইফয়েডে দু’বেলা অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদি বলেন, ‘টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের লক্ষণ একই। দুটোই পানিবাহিত রোগ। আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর হয়। জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রথম এক সপ্তাহ পায়খানা কষা হয়, পরের দিকে পায়খানা পাতলা হয়। পেটে ব্যথা হয়, খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।’

এদিকে নগরীর বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসি ঘুরে জানা গেছে, সম্প্রতি জ্বর, পাতলা পায়খানা ও জন্ডিসের ভিটামিন ওষুধ বিক্রি বেড়েছে। ডাক্তারের কাছে না গিয়ে জ্বর ও পেটের পীড়ার এসব ওষুধ কিনে খাচ্ছে অনেক রোগী।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের বহির্বিভাগের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান ডা. মো. শাহেদ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিদিন বহির্বিভাগে সাত থেকে আটজন টাইফয়েড রোগী আসছে। তবে যারা আসছেন, তারা দেরী করে আসছেন। এমনও টাইফয়েডের রোগী পাচ্ছি, তারা অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ কমপ্লিট করে এসেছে। অবশ্য এই রোগীরা ডেঙ্গু পরীক্ষা করে নেগেটিভ রিপোর্ট পেলেও টাইফয়েড টেস্ট করার প্রয়োজনীতা মনে করেননি।’

তেমনই এক রোগী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আসিফ ইকবাল। জ্বর নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের বহির্বিভাগে দেখালে ডাক্তার তাকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে দেন। ডেঙ্গুর রিপোর্ট নেগেটিভ যখন হাতে আসে তখন তার জ্বর চারদিনে গড়িয়েছে। এরমধ্যে শুরু হয় বমি ও প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। এরপর বাসায় কেটে যায় আরও দু’দিন। অসুস্থতা তীব্র হলে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে আনার পর রাখা হয় অবজারভেশনে। সেখানে আরও একদিন রাখার পর তাকে ভর্তি করা হয় ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে। পরে ডাক্তার টাইফয়েড শনাক্তের জন্য ব্লাড কালচার পরীক্ষা করতে দেন।

এরপর শুরু হয় আসিফের টাইফয়েডের চিকিৎসা। চলে দু’বেলা করে অ্যান্টিবায়েটিক ইনজেকশন। কিন্তু এই ধকলে আসিফের শরীর এখন প্রচণ্ড দুর্বল। শুধুমাত্র দেরীতে টাইফয়েডের চিকিৎসা শুরু হওয়ায় ধকল সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে তার।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফাহিম রেজা বলেন, ‘যেকোনো বয়সেই টাইফয়েড হতে পারে, তবে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শরীরে জীবাণু প্রবেশ করলেই টাইফয়েড হবে—এমন কোনো কথা নেই। কারণ দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে অনেক সময় জীবাণু সংক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু শিশুদের শরীর টাইফয়েডের জীবাণু প্রতিরোধ করতে পারে না। তাই মা ও শিশু হাসপাতালে প্রতিদিন আট থেকে ১০ জন টাইফয়েডের শিশু রোগী পাওয়া যাচ্ছে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৬ নম্বর মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, ‘ডেঙ্গুর মতোই টাইফয়েড রোগীকে চিকিৎসার পাশাপাশি অধিক পরিমাণে তরল খাবার দিতে হবে। কারণ দীর্ঘস্থায়ী জ্বর এবং ডায়রিয়ার কারণে রোগীর শরীরে পানি স্বল্পতা দেখা দেয়। টাইফয়েডের রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। জ্বর বেশি থাকলে পুরো শরীর ভেজা গামছা বা তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতে হবে। উচ্চ ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। প্রতিবার বাথরুম ব্যবহারের পর হাত পানি ও সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে ফেলতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যতদিন পর্যন্ত চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দেবেন, ততদিন পর্যন্ত তা গ্রহণ করতে হবে। পানি ফুটিয়ে খেতে হবে এবং স্ট্রিট ফুড খাওয়া যাবে না।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!