চট্টগ্রামে ব্যাংকার স্বামীর নিষ্ঠুরতা, গর্ভবতী গৃহবধূকে ভাসুরের লাথি (ভিডিও)

৫ বছরের শিশুকে তালাবদ্ধ করে পালান ব্যাংকার বাবা

চট্টগ্রামে এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালিয়েছে তার ব্যাংকার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। যৌতুকের ২০ লাখ টাকা আদায় করতে প্রায়ই ওই গৃহবধূকে মারধর করতেন তারা। এই ঘটনায় মামলা করলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তারা। বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা।

সর্বশেষ গত সোমবার (১৬ অক্টোবর) স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বেধড়ক মারধরের শিকার হন ওই গৃহবধূ। মারধরের এক পর্যায়ে স্বামীর বড় ভাই অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর পেটে লাথি মারলে গুরুতর আহত হন তিনি। পরে আহত নিগার সুলতানা বুয়ার নম্বর থেকে তার বড় ভাইকে ফোন দেন। তার বড় ভাই ৯৯৯ এ ফোন দিলে পুলিশ এসে রক্তাক্ত অবস্থায় নিগারকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।

এই ঘটনায় মামলা হলে ওই গৃহবধূর স্বামী পাঁচ বছর বয়সী ছেলে জাইরকে কাজের বুয়ার সঙ্গে ঘরে তালাবদ্ধ রেখে পালিয়ে যান। পরে পুলিশ গিয়ে ছেলেটিকে উদ্ধার করে।

ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূর নাম নিগার সুলতানা (২৭)। তিনি চকবাজার এলাকার সিরাজ উল্লাহর মেয়ে এবং আগ্রাবাদের দেওয়ানহাটের মিস্ত্রিপাড়া এলাকার মধুর বাড়ির ইসলাম মিয়ার (৩৬) স্ত্রী। ইসলাম মিয়া আগ্রাবাদের ওয়ান ব্যাংকের ইসলামিক ব্যাংকিং ব্রাঞ্চে কর্মরত আছেন।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরও নিগারকে একবার মারধর করেন তার ভাসুরের বউ ও দুই ছেলে। পরে তারা আবারও তাকে চলতি বছরের ১৬ জুলাই মারধর করেন। এই ঘটনার পর নিগার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় গত ১৫ অক্টোবর জামিন নেন আসামিরা। জামিন পেয়ে পরদিন সোমবার নিগারের ওপর চড়াও হন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। মামলা করায় নিগারকে বেধড়ক পেটান তারা।

এছাড়া ২০২২ সালে ৪ মে একবার মারধর করা হয় নিগারকে। এর কিছুদিন পর আবারও ওই বছরের ১৯ জুন মারধর করে। এরপর আহত নিগার বাবার বাড়ি চলে আসেন এবং সুস্থ হওয়ার পর ওই বছরের ৭ জুলাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। পরে স্ত্রীকে আর মারধর করবেন না মর্মে স্থানীয় কাউন্সিলরের সামনে অঙ্গীকারনামা দিয়ে আপোষ করে নেন স্বামী ইসলাম মিয়া।

এদিকে সোমবার মারধরের সময় পেটে ভাসুরের লাথির আঘাতে রক্তপাত শুরু হয় নিগারের। এরপর তাকে ভর্তি করানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। সেখান থেকে চিকিৎসা শেষে ১৮ অক্টোবর নগরীর ডবলমুরিং থানায় মামলা করেন তিনি।

মামলায় আসমিরা হলেন নিগারের স্বামী ইসলাম মিয়া, মো. খুরশিদ আলম (৪৬), মো. মোসলেম মিয়া (৪১), মিনহাজুল আলম বিজয় (২৯) এবং নাছরিন আক্তার বুবলি।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, বাড়ির ৫ম তলার কাজ করতে ২০ লাখ টাকা যৌতুক দাবিতে নিগার সুলতানাকে চাপ দিতে থাকেন স্বামী ইসলাম মিয়া। বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে অপারগতা জানান নিগার। এরপর টাকার দাবিতে এবং মামলা করার জেরে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কাঠের তৈরি রুটির বেলন দিয়ে নিগারের মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করেন ইসলাম। এরপর তার ভাই মো. খুরশিদ আলম অন্তঃসত্ত্বা নিগারের তলপেটে লাথি মারেন। লাথির আঘাতে নিগারের রক্তপাত শুরু হয়। আসামিরা সংঘবদ্ধ হয়ে নিগারকে মারধর করেন।

ভুক্তভোগী নিগার সুলতানা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০ লাখ টাকা যৌতুক দিতে অপারগতা জানাই আমি। এরপর মামলার করার কারণে এবং টাকা দিতে অপারগতা জানালে আমার স্বামী আমাকে রুটি তৈরির বেলন দিয়ে মারধর করেন। খুরশিদ আলম আমার পেটে লাথি মারেন। এরপর থেকে রক্তপাত শুরু হয়। সবাই মিলে লোহার রড, গাছের বাটাম দিয়ে মারধর করেন। তারা আমার মোবাইল ফোন নিয়ে ফেললে আমি কাজের বুয়ার নম্বর থেকে আমার বড় ভাইকে কল দিই। সে ৯৯৯ এ কল দিলে পুলিশ এসে আমাকে উদ্ধার করে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যায় আমার স্বজনরা।’

তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে যৌতুকের জন্য তারা আমার ওপর অত্যাচার করে আসছে। একাধিকবার শালিশি বৈঠকের মাধ্যমে মীমাংসা হলেও তাদের স্বভাব ঠিক হয়নি। আমার বাচ্চা দিকে চেয়ে এতোদিন সংসার করেছি। আমাকে নির্যাতন করবে না বলে স্থানীয় কাউন্সিলরের সামনে অঙ্গীকারনামাও দেন আমার স্বামী। কিন্তু তবুও দফায় দফায় আমাকে নির্যাতন করে আসছে তারা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী এতটাই পাষণ্ড, সে আমার ছেলেকে কাজের বুয়ার সঙ্গে ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ গিয়ে আমার ছেলেকে উদ্ধার করে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডবলমুরিং থানার উপ পরিদর্শক পল্টু বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) রাতে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে থানায় আসেন নিগার সুলতানা। ওসি স্যার ঘটনার বিষয়ে জেনে তাদেরকে এজাহার জমা দিতে বলেন। এরপর এজাহার জমা হলে রাতে আসামিদের বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে আসামি ও বাচ্চার খোঁজ নিলে দেখি, নিগার সুলতানার স্বামী ইসলাম ছেলেটিকে কাজের বুয়ার সঙ্গে ঘরের মধ্যে তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যান। সেখানে ছেলেটি কান্নাকাটি করলে আমরা তাকে উদ্ধার করে তার মায়ের হাতে তুলে দিই। আসামিদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউকের কাছে জানতে চাইলে শালিশি বৈঠকের পর অঙ্গীকারনামার বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘যেহেতু মামলা হয়েছে সেহেতু ঘটনাটি আইনগতভাবে সমাধান হবে।’

এই বিষয়ে জানতে নিগার সুলতানার স্বামী অভিযুক্ত ইসলাম মিয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

আরএম/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!