চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর ‘ফলস্’ নেগেটিভ রিপোর্টে বাড়ছে মৃত্যু, ‘নেগেটিভ’ হলেও চিকিৎসা লাগবেই

তিনদিনের মধ্যে করতে হবে এনএস১ টেস্ট, তিনদিন পর এন্টিবডি

আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে (আইআইইউসি) ইংরেজি সাহিত্যের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আফনান নাছির বর্ষা। তীব্র জ্বর নিয়ে গত ২১ আগস্ট ভর্তি হন আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তার ডেঙ্গু টেস্ট করতে দিলে এনএস১ রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। কিন্তু জ্বরের পাঁচদিনের মাথায় হঠাৎ করে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় বর্ষার। কমতে শুরু করে রক্তের প্লাটিলেট। পরে ডাক্তার এন্টিবডি টেস্ট করে নিশ্চিত হন বর্ষা ডেঙ্গু আক্রান্ত। ততদিনে বর্ষার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এরপর তাকে নেওয়া হয় আইসিইউতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, বুধবার (৩১ আগস্ট) মারা যান বর্ষা।

ডেঙ্গুর এমন ফলস্ রিপোর্টের কারণে রোগীর মৃত্যুর বাড়ছে চট্টগ্রামে। শুরুতে টেস্ট করানোর পর নেগেটিভ আসলে চিকিৎসা নিতে অবহেলা ও অনিয়মের করছেন রোগী। ফলে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার পরও বাঁচছেন না এসব রোগী।

কিন্তু নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরও রোগীর যদি ডেঙ্গুর লক্ষণ থাকে তাহলে সেই রোগীকে ডেঙ্গুর চিকিৎসাই নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। আর সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খেতে হবে। আর খাবার খেতে না পারলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে, এক্ষেত্রে কোনো অবহেলা করা যাবে না। একইসঙ্গে জ্বর আক্রান্ত হওয়ার তিনদিনের মধ্যেই ডেঙ্গুর এনএস১ পরীক্ষা করাতে হবে। কারণ তিনদিন পর পরীক্ষার রিপোর্টে ডেঙ্গু ধরা না পড়ার সম্ভাবনা বেশি। আর তিনদিন পর করাতে হবে ডেঙ্গুর এন্টিবডি টেস্ট।

এমনই আরেক রোগী চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কদমরসুল গ্রামের আব্দুল মাবুদের সাড়ে পাঁচ বছরের ছেলে জাহিদ। জ্বরের চারদিনের মাথায় ছেলেকে বাঁশখালী সদরে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ফারুককে দেখান মাবুদ। বাড়িতে এসে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খাওয়ানোর পরও জাহিদের জ্বর কমেনি, পেটে ব্যথা শুরু হয়।

সাতদিন পর আবারও ডা. ফারুকের কাছে গেলে তিনি জাহিদকে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে আরেক শিশু ডাক্তারকে দেখানো হয়। ওই ডাক্তার ডেঙ্গু টেস্ট দিলে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। এরপর জাহিদের পায়খানার সঙ্গে রক্ত যেতে শুরু করে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করালে এন্টিবডি পরীক্ষা করে ডেঙ্গু নিশ্চিত হন ডাক্তার। ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। আইসিইউতে নিয়ে গিয়েও বাঁচানো যায়নি তাকে।

জানা গেছে, এপিক হেলথ কেয়ারে গড়ে ৯৫ থেকে ১০০টি ডেঙ্গু টেস্ট হয়ে থাকে। কিন্তু পজিটিভ হয় ১০ থেকে ১২টি। মূলত প্রথমবার ডেঙ্গু টেস্ট করানোর পর নেগেটিভ আসার পর অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে অবহেলা করছেন। ফলে পরবর্তীতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাদের আর বাঁচানো যাচ্ছে না।

ডেঙ্গুর ফলস্ রিপোর্ট নিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। রোটারিয়ান সাইফুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন, ‘ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে সবচেয়ে বেশি টেস্ট হচ্ছে ডেঙ্গুর। মানুষজন সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে ভিড় করছেন হাসপাতালগুলোতে। ৮০% রিপোর্টের ফলাফল আসছে নেগেটিভ। কিন্তু ডেঙ্গুর সকল সিনড্রোম নিয়ে রোগীরা হাসপাতাল ও বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছে। ডেঙ্গুর নতুন ভ্যারিয়েন্ট অজানাই থেকে গেল।’

এপিক হেলথ কেয়ারের ম্যানেজার (অপারেশন) ডা. হামিদ হাসান কায়সার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে ফলস্ নেগেটিভ রিপোর্ট সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘রোগীর লক্ষণ, সিবিসি, তার এন্টিবডি বা এনএস১ রিপোর্ট, আদারস প্যারামিটার—সবগুলো দেখে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেবেন, ডেঙ্গু নেগেটিভ নাকি পজিটিভ।’

তিনি বলেন, ‘টেস্টের কন্ট্রোল লাইনটা যদি গাঢ় রঙের আসে, তখন ধরে নিই এটি শতভাগ পজিটিভ। আর যেটা ঝাপসা, সেটিকে ফলস্ নেগেটিভ বলি। তবে আমরা মেনশন করি, পজিটিভ অথবা নেগেটিভ। ডেঙ্গু যে মেথডে টেস্ট করি, সেই (immunochromatographic test-ICT) মেথডে স্ট্যান্ডার্ড বলা হয় না, একটা ধারণা করা হয়। ডায়াগনোসিস, শরীরের কন্ডিশন—ওভারঅল সব বিষয় দেখে ধারণা করা হয়, এটা ডেঙ্গু কিনা। ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য এটি আইডিয়াল টেস্ট না, কীট টেস্ট। কীট টেস্টকে আইডিয়াল টেস্ট বলা হয় না।’

হামিদ হাসান কায়সার বলেন, ‘লক্ষণ দেখা দেওয়ার তিনদিনের মধ্যেই টেস্ট করাতে হবে। সাধারণত আমরা ডেঙ্গুর এনএস১ অ্যান্টিজেন নামের যে টেস্টটি করি, সেটি লক্ষণ দেখা দেওয়ার তিনদিন পর করালে রোগীর সঠিক রিপোর্ট পাওয়া যায় না। তাই তিনদিনের মধ্যেই টেস্ট করাতে হবে। তিনদিন পর করাতে হবে ডেঙ্গুর এন্টিবডি টেস্ট।‘

চট্টগ্রাম মেডিকেলের এনসিলারি ভবনের চারতলায় অবস্থিত প্যাথলজি ল্যাবে জুলাই মাসে ডেঙ্গু টেস্ট হয়েছে ৫ হাজার ৫৯০ জনের। এর মধ্যে ডেঙ্গু পজিটিভ এসেছে ৬৭৩ জনের। অন্যদিকে আগস্ট মাসে ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়েছে ৫ হাজার ৩৪১ জনের। এর মধ্যে পজিটিভ এসেছে ৬০৭ জনের।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও ডেঙ্গুর ফোকাল পার্সন অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, ‘সন্দেহজনক ডেঙ্গুতে সব ধরনের লক্ষণই থাকে। কিন্তু এনএস১ নেগেটিভ আসে। রক্তের মধ্যে যে এন্টিজেন থাকার কথা, সেটি পাওয়া যায় না। ডেঙ্গুর সেনসিভিটি এনএস১। যেটি শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ, কিন্তু সেটি শতভাগ হয় না। ১০০ জন রোগীর মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগীর ডেঙ্গুর ফলস্ নেগেটিভ রিপোর্ট আসে।’

ফলস্ নেগেটিভ রিপোর্টের পরবর্তী ডেঞ্জার পিরিয়ডের বিষয়ে ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, ‘ডেঙ্গু টেস্ট নেগেটিভ আসার পর অনেকে মনে করেন ডেঙ্গু হয়নি। সেক্ষেত্রে তারা বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দেন না। পরে অবস্থা বেগতিক হলে সিরিয়াস হতে দেখা যায়, ততক্ষণে রোগী অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে চলে যতে পারেন।’

তবে এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুস সাত্তার বলেন, ‘রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরও যাদের মধ্যে ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণ থাকবে এবং প্লাটিলেট এক লাখের নিচে থাকবে, তাদের রিপোর্ট নেগেটিভ আসলেও পজিটিভ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। তাকে ডেঙ্গু রোগী হিসেবে চিকিৎসা নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ করতে হবে, প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে। তবে রোগীর খাবার গ্রহণ যদি অসম্ভব হয়, বমি হয়; তাহলে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। টেস্ট নেগেটিভ হওয়ার পরও লক্ষণ থাকলে অযথা বসে না থেকে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।’

এদিকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১৪৫ জন। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় কেউ মারা যাননি। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে এসব তথ্য। চট্টগ্রামে এখনও পর্যন্ত মারা গেছেন ৫৩ জন, এরমধ্যে শুধুমাত্র আগস্টেই মারা গেছেন ২৮ জন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!