চট্টগ্রামের ৮ দুর্নীতির ঘটনা ধরিয়ে দিয়েই চক্ষুশূল দুদক কর্মকর্তা শরীফ

প্রথমে বদলি, পরে হুমকি, শেষমেশ চাকরিচ্যূতি

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে খুব বেশি বড় নয়, মাঝারি পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের মৌচাকে ঢিল ছুঁড়েই তাদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেছিলেন চট্টগ্রামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। মূলত তাদের সম্মিলিত তদবিরেই তাকে গত বছরের জুনে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। এরপর ক্রমাগত হুমকি-ধমকির মধ্যে শেষ পর্যন্ত তাকে চাকরিচ্যূতই করে দিল দুর্নীতিবিরোধী হিসেবে কথিত সংস্থাটি। এমন চৌকস কর্মকর্তার হঠাৎ চাকরিচ্যূতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল সমালোচনা, অনেকেই প্রকাশ করছেন খোলাখুলি ক্ষোভও। এর বিপরীতে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের মুখে ফুটেছে সাফল্যের হাসি। তাদের অনেকে আবার কাছের মানুষদের কাছে সেই ‘সাফল্যে’ প্রকাশ করছেন স্বস্তিও।

মাত্র দুই বছরে দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের-২ উপ-সহকারী পরিচালক থাকা অবস্থায় মো.শরীফ উদ্দিন অনেকগুলো অবিশ্বাস্য দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন করেছেন। তার তদন্তে উঠে এসেছে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ নেতা, বিএনপি নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, চিকিৎসক নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার দুর্নীতিবাজদের চমকজাগানো সব তথ্যপ্রমাণ।

বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সেই শরীফ উদ্দিনকে হঠাৎ জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে চাকরি থেকে অপসারণ করলো দুর্নীতি দমন কমিশন। অথচ তাকে ইতিপূর্বে কোনো ধরনের কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়নি।

এবার দেখে নেওয়া যাক, গত দুই বছরে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন কোন্ কোন্ বিষয় নিয়ে তদন্তে নেমেছিলেন আর কোন্ কোন্ প্রভাবশালীর মৌচাকে ঢিল ছুঁড়েছিলেন।

হারানো ল্যাপটপেই ভোটার ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা

২০১২ সালে রহস্যজনকভাবে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কমিশনের সাতটি ল্যাপটপ হারিয়ে যায়। পরে এ ঘটনায় একাধিক মামলা হলেও তৎকালীন জেলা নির্বাচন অফিসারসহ সংশ্লিষ্টরা কোনো পদক্ষেপ নেননি। সবচেয়ে বিস্ময়কর হল— হারিয়ে যাওয়া একটি ল্যাপটপ দিয়ে রোহিঙ্গাসহ মোট ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার এমন নজিরবিহীন অভিযোগে ২০২১ সালের ১৬ জুন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিবালয়ের পরিচালকসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বাদি হয়ে এই মামলা করেন। মামলার চার আসামি হলেন চট্টগ্রাম জেলার সাবেক সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা ও ইসি সচিবালয়ের বর্তমান পরিচালক খোরশেদ আলম, জেলা নির্বাচন অফিসের সাবেক উচ্চমান সহকারী মাহফুজুল ইসলাম, সাবেক অফিস সহায়ক রাসেল বড়ুয়া ও পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের সাবেক টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মোস্তফা ফারুক।

কক্সবাজারে ২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা

কক্সবাজারে অগ্রাধিকারভিত্তিক মেগা প্রকল্পসহ ৭৫টি প্রকল্প উন্নয়নের কাজ চলছে। এর মধ্যে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, এসপিএম প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, ট্যুরিজম পার্ক, সাবমেরিন বেস, রেল ট্র্যাকস, শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, পিবিআই কার্যালয়, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প অন্যতম। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০ হাজার একরেরও বেশি ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আর এই ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে ঘটেছে অবিশ্বাস্য সব দুর্নীতির ঘটনা। তদন্তে নেমে দুর্নীতি দমন কমিশন উদঘাটন করে ভূমি মালিকদের অধিগ্রহণ বাবদ পাওয়া ৮ হাজার কোটি টাকা থেকে কৌশলে ১৫ ভাগ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন হিসেবে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। এই চক্রে রয়েছেন কক্সবাজারের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ নেতা, বিএনপি নেতা, আইনজীবীসহ কয়েকজন সাংবাদিকও। এ ছাড়াও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান ৫৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ পায় দুদক। এ ঘটনায় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানসহ তার ছেলে ছাড়াও কয়েকজন কাউন্সিলরের ব্যাংক একাউন্টে থাকা কয়েক কোটি টাকা জব্দও করা হয়।

চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি অনুসন্ধান

২০২০ সালের মাঝামাঝিতে শরীফ উদ্দিনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম-দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সেই তদন্তে বেরিয়ে আসে চট্টগ্রামের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘিরে অনিয়ম ও দুর্নীতির অবিশ্বাস্য সব চিত্র। তার আগেই বিএমএ নেতা ফয়সল ইকবালের অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট ১২ দফা অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। তাতে বলা হয়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক নিয়োগ ও বদলি অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ফয়সল ইকবাল বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে কেবল ২০১৯-২০২০ অর্থবছরেই ওই হাসপাতালে প্রায় ৪২ কোটি টাকার টেন্ডার তিনি একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এছাড়া তিনি চমেক হাসপাতালের নিয়োগ থেকে বদলি, কোটি কোটি টাকার খাবার সরবরাহ, আউটসোর্সিং ব্যবসা, এমনকি ঠিকাদারিসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন।

এমন সব অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করেন দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের-২ উপ-সহকারী পরিচালক মো.শরীফ উদ্দিন। দীর্ঘ তদন্তে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেন্ডার, খাবার সরবরাহ, চুক্তিভিত্তিক লোক সরবরাহ, রক্ত সঞ্চালন বিভাগের অনিয়ম, কেনাকাটা এবং ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন খাতে বিপুল অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য মেলে। জব্দ করা হয় কয়েকটি ব্যাংক একাউন্টও। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পর বিস্তারিত প্রতিবেদনও দুদকে পেশ করেন শরীফ উদ্দিন। কিন্তু সেটি এখন পর্যন্ত ধামাচাপা পড়ে আছে রহস্যজনক কারণে।

রেলওয়ের নিয়োগে দুর্নীতির ঘটনা

২০২১ সালের ৩১ মার্চ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে খালাসি নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে রেলওয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ফারুক আহমদসহ ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। এতে অভিযোগ আনা হয়, ৮৬৩ জন খালাসি নিয়োগকালে নিয়োগ কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে দুইজন সদস্যের ইন্ডিভিজুয়াল মার্কশিট না থাকা, কম্বাইন্ড মার্কশিটে ৪ জনের নম্বর দেখানো হলেও একজনের মূল্যায়ন মার্ক অসৎ উদ্দেশ্যে সৃজন করে প্রতারণাপূর্বক ১৯ জনকে নিয়োগ প্রদান, দুইজন নিয়োগ প্রার্থীকে চার জেলা থেকে নিয়োগ, বয়স্ক ও জাল সনদধারী লোকদের জাল সনদ সৃজনপূর্বক ব্যবহার করে চাকরি প্রদান করার অসৎ উদ্দেশ্যে নিজেরা লাভবান হয়ে বা অন্যকে অন্যায় লাভে লাভবান করে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক একে অপরের সহযোগিতায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ সম্পৃক্ত অপরাধ ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা গ্রহণ করে ভোগ দখল ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করেছেন।

এই মামলার অন্য আসামিরা হলেন তৎকালীন প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী বর্তমানে ঢাকা রেলভবনে কর্মরত মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) মিজানুর রহমান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক জোবেদা আক্তার, সাবেক ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার বর্তমানে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের টিএসও মো. রফিকুল ইসলাম, এমএলএমএস হারাধন দত্ত, শাহজাহানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক সুরাইয়া সুলতানা, খালাসি মো. আবুল বশর খাঁন, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিপিও দপ্তরের প্রধান সহকারী খন্দকার সাইফুল ইসলাম মামুন, টিকিট প্রিন্টিং প্রেস কলোনি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি দাশ, শাহজাহানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আক্তার হোসেন, কুমিল্লার মেসার্স ফাতেমা এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটর আমিরুজ্জামান আশীষ ও মোসাম্মৎ পারভীন আক্তার।

তিন প্রকল্পে ৮০ কোটি টাকার দুর্নীতি উদঘাটন

কক্সবাজারের কলাতলী পৌরসভা এলাকায় দুই একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ও পিবিআইয়ের দপ্তর নির্মাণে এ জমি অধিগ্রহণ করা হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু সেই জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সময় নেওয়া হয় চরম জালিয়াতির আশ্রয়। আসল মালিকদের বঞ্চিত করে জেলা প্রশাসনের তৎকালীন দুজন কর্মকর্তার যোগসাজশে ভুয়া মালিক তৈরি করে ২০ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় তদন্তে নামে দুদক। এতে দেখা যায়, যাদের নাম ফিল্ডবুক জরিপে ছিল না তাদের জমি অধিগ্রহণের টাকা ও চেক দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাদের নামে জমি অধিগ্রহণের কোনো নোটিশও দেয়া হয়নি। জমির দখলে থাকা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ না দিতে তড়িঘড়ি করে একসঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রায় ১৭ কোটি টাকার চেক দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে পৃথকভাবে আরও সাড়ে ৩ কোটি টাকা অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করা হয়। কক্সবাজার জেলার তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. শামীম হোসাইন ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে ভূমি অধিগ্রহণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অর্থ না দিয়ে অভিযুক্তদের অধিগ্রহণের টাকা পাইয়ে দেওয়ার তথ্য উঠে আসে দুদকের তদন্তে। এই জালিয়াতির তদন্ত করেন দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এর উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন।

কক্সবাজারে এ ধরনের আরও দুটি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রায় ৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কক্সবাজারে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদের একটি সিন্ডিকেট। ওই দুটি প্রকল্পে সুকৌশলে জমি কেনা হয়েছে বেশি দাম দিয়ে। এতে সরকারের ৪৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।

তিন প্রকল্পে এসব দুর্নীতির ঘটনায় দুদক তিনটি পৃথক মামলা করে। প্রশাসন ক্যাডারের ২৩ কর্মকর্তাসহ মোট ৪৪ জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা হয় দুর্নীতির অভিযোগ। এই অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারের সাবেক উপকমিশনার, সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার, সাবেক ইউএনও, পিবিআইয়ের কক্সবাজার ইউনিটের সাবেক পুলিশ সুপার ও সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ চার কর্মকর্তা। এছাড়াও অভিযোগ আনা হয় ২৩ জন সার্ভেয়ার, সাতজন কানুনগো, ছয়জন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ও দুজন সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে।

অবৈধ গ্যাস সংযোগ সাবেক মন্ত্রীপুত্রের ঘরে

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে মুজিবুর রহমানকে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ স্থানান্তর ও নতুন সংযোগ দেওয়ার অভিযোগে ২০২১ সালের জুনে দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এর উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় মোট পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এরা হলেন কেজিডিসিএল’র মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং ও সার্ভিসেস) মো. সারওয়ার হোসেন, কেজিডিসিএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সাবেক ব্যবস্থাপক মজিবুর রহমান, সার্ভেয়ার দিদারুল আলম এবং অবৈধভাবে সংযোগ পাওয়া গ্রাহক মুজিবুর রহমান। এই মামলায় মহাব্যবস্থাপক সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মুজিবুর রহমান ও সার্ভেয়ার দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তারও করে দুদক।

ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, নগরীর হালিশহর এলাকার বাসিন্দা এম এ সালাম নামে এক গ্রাহকের (বতমানে মৃত) নামে বরাদ্দকৃত ১৮টি অব্যবহৃত দ্বৈত চুলার সংযোগ ছিল। এর থেকে ছয়টি দ্বৈত চুলা রেখে বাকি ১২টি দ্বৈত চুলা মৃত সালামের স্ত্রী নুরজাহান সালামের নামে ভুয়া চুক্তিনামা তৈরি করে নগরীর চান্দগাঁও সানোয়ারা আবাসিক এলাকার গ্রাহক মুজিবুর রহমানের নামে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাস সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকলেও অবৈধভাবে সানোয়ারা আবাসিক এলাকায় আরও ১০টি সংযোগ দেওয়া হয় মুজিবুর রহমানের নামে। ২০১৭ সালের ২ মার্চ থেকে পরের বছরের ২ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এসব সংযোগ দেওয়া হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এভাবে ভুয়া আবেদনপত্র তৈরির মাধ্যমে মুজিবুর রহমানের নামে মোট ২২টি অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। মুজিবুর রহমান সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে এবং আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য।

জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় রোহিঙ্গাদের এনআইডি

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা এক নারী ও তার কথিত বাবা-মাকে জাতীয়তা এবং জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়ার অভিযোগে ২০২১ সালের ১২ জুন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালির বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। তবে মামলার আগেই কথিত বাবা-মা ওই রোহিঙ্গারা সনদগুলো ব্যবহার করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ছেড়ে যান। এই মামলার অন্য আসামিরা হলেন পাথরঘাটা ওয়ার্ড কার্যালয়ের জন্ম নিবন্ধন সনদ সহকারী সুবর্ণ দত্ত, দালাল সিরাজুল ইসলাম, ২৬ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী অহিদা এবং তার কথিত বাবা-মা মোহাম্মদ ইসমাইল ও মেহেরজান।

একই বছরের ১৫ জুন অবৈধ উপায়ে রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের ঘটনায় ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের রাসেলসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এই মামলাটিও দায়ের করেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন— ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের জন্ম নিবন্ধন সহকারী ফরহাদ হোসাইন, ডবলমুরিং নির্বাচন অফিসের সাবেক ডাটা এন্ট্রি অপারেটর শাহ জামাল, পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের প্রুফ রিডার উৎপল বড়ুয়া, একই পদের রন্তু বড়ুয়া ও সাবেক পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসার আব্দুল লতিফ শেখ।

রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয়তা সনদ ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তা-কর্মচারী ও হাটহাজারীর সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে একই দিন আরও এক মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম ২-এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদি হয়ে যে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন, তারা হলেন— ডবলমুরিং নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী জয়নাল আবেদীন, চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক নূর আহম্মদ, হাটহাজারী উপজেলা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. সাইফুদ্দিন চৌধুরী, কেরানীগঞ্জ নির্বাচন অফিসের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সত্য সুন্দর দে, হাটহাজারী মির্জাপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আবছার, ওই ইউপির সদস্য মো. নুরুল ইসলাম, জন্মসনদ প্রস্তুতকারী মোহাম্মদ বেলাল, দালাল মো. আবদুস ছালাম ও তার পিতা মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, রোহিঙ্গা নারী লাকী আক্তার এবং রোহিঙ্গা নাগরিক নাজির আহমেদ।

কেজিডিসিএলে দুর্নীতির চক্র

২০২০ সালের ২২ আগস্ট চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনলাইন সংস্করণে ‘কর্ণফুলী গ্যাসে মধ্যরাতের পদোন্নতি পেলেন ৩৭ ‘ভুয়া’ কর্মকর্তা : দুদকের ক্লিয়ারেন্স নিয়ে আরেক জালিয়াতি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ না করে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার পর কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে ১০ বছর আগে ৩৭ জন লোক ‘নিয়োগ’ পেয়েছিলেন সহকারী ব্যবস্থাপক পদে। জালিয়াতি ধামাচাপা দিতে এমনকি তাদের কোনো নথিপত্রও রাখা হয়নি। এদের নিয়োগ পরীক্ষার কোনো নথি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার খাতা—কিছুই পাওয়া যায়নি। কারও কারও সনদও জাল। কেউ কেউ পাশের আগে পাশ দেখিয়ে সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন নিয়োগের সময়। এমন নজিরবিহীন কাণ্ডে নিয়োগ পাওয়া সেই কথিত ‘কমকর্তারা’ গত ১০ বছরে এমনকি পদোন্নতিও বাগিয়ে নিয়েছেন। ২০১৯ সালে এ ঘটনা জেনে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই তদন্ত চলমান থাকা অবস্থাতেই ২০২০ সালের ২০ আগস্ট রাত ১২টার দিকে ওই ৩৭ জন কথিত কর্মকর্তাকে আবার পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরে এই ঘটনায় তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতি তথ্যপ্রমাণ পেয়ে কেজিডিসিএলের সাবেক এমডি আইয়ুব খান চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করেন দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন।

এদিকে চট্টগ্রামভিত্তিক কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবরে দাখিল করার পর গত ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনের চট্টগ্রামের খুলশীর ভাড়া বাসায় নিচে এসে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেন কেজিডিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং পেট্রোবাংলা পরিকল্পনা ও পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক মো. আইয়ুব খান চৌধুরী এবং কেজিডিসিএলের আরেক কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মোরশেদ উল্লাহ। দারোয়ানের উপস্থিতিতে আইয়ুব খান চৌধুরী এ সময় বলেন, শরীফ উদ্দিনের কারণে তার জীবন ধ্বংস হয়েছে। তিনি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নিউজ করিয়েছেন। দুদকে কিভাবে চাকরি করেন দেখে নেবেন আইয়ুব খান। চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে তার মতো অনেকের জীবন ধ্বংস করেছেন শরীফ উদ্দিন।

ওইদিনের হুমকির ১৬ দিনের মাথায় চাকরি হারালেন দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন।

কর্মস্থলে কর্মরত থাকা অবস্থায় কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই হঠাৎ চাকরি থেকে অপসারণের বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাকে ইতিপূর্বে কর্তৃপক্ষ থেকে অপসারণ করার বিষয়ে কোনো ধরনের কারণ দর্শানো নোটিশ করা হয়নি। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়। এভাবে হঠাৎ করে চাকরি থেকে অপসারণ করে আমার প্রতি কমিশন অবিচার করেছে। আমি কখনও কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করিনি বলে আজ আমার এই পরিণতি। আমি কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায়বিচার চাই।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!