চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে সর্দি কাশি জ্বর, অহেতুক ভয় বাড়াচ্ছে করোনা

নামি ডাক্তাররা বলছেন মৌসুমী অসুখ ৩-৪ দিনেই সেরে যাচ্ছে

১০ বছরের শিশু ফাহিমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন তার মা। দুই-তিনদিন ধরেই ফাহিমার ১০২ ডিগ্রি জ্বর। কিছুতেই কমছে না। সাথে আছে সর্দিকাশিও। মা নিজেও খুব ভয়ে আছেন। কারণ এখনও করোনা অনেকটাই আগের রূপে। তবে ডাক্তার বলেছেন, এটা সাধারণ জ্বর। তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই। ফাহিমার মা বললেন, ‘করোনার মধ্যে এখন সামান্য জ্বর হলেও ভয় লেগে থাকে করোনা পজিটিভ হলো কিনা। আমরা যথেষ্ট সচেতন হয়ে চলাফেরা করছি। তাও কেন সন্তান অসুস্থ হলো তা নিয়ে পুরো পরিবার চিন্তায় পড়ে গেলাম।’

শুধু ফাহিমার পরিবারেই নয়, চট্টগ্রামে সপ্তাহখানেক ধরে বেশিরভাগ পরিবারেই জ্বর ও সর্দি-কাশির প্রকোপ দেখা দিয়েছে। কী নগর কী গ্রাম— সবখানেই এই অবস্থা। আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। করোনার মধ্যে মৌসুমী এই অসুখে আক্রান্ত রোগীর সাথে সাথে ভোগান্তি ও আতঙ্কে আছেন পরিবারের সুস্থ সদস্যরাও। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এই জ্বর ও সর্দি-কাশি বেশিরভাগই মৌসুমী অসুখ বলছেন চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, হঠাৎ গরম আবার ঠান্ডা ছাড়াও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে সর্দিকাশি কিংবা ভাইরাস জ্বর হয়ে থাকে। ঋতু পরিবর্তনের কারণে নগরীতে ভাইরাসজনিত জ্বরের সাথে দেখা দিয়েছে সর্দিকাশিও। অন্যদের তুলনায় কিশোরদের এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। করোনাভাইরাসের উপসর্গের সাথে মিল থাকায় এই রোগ নিয়ে আতঙ্কিত সবাই।

কর্ণফুলী এলাকার বাসিন্দা নাছিমা আকতার বললেন, ‘৭ দিন ধরে ঘর থেকে বের হইনি করোনার মধ্যে। তাও আমার দুধের বাচ্চার গত একসপ্তাহ ধরে কাশি ও জ্বর। করোনার ভয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এই অসুখ— এমন বলে এন্টিবায়োটিক দিলেন ডাক্তার। সাথে ঘরোয়া কিছু ট্রিটমেন্ট দিলেন।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘সপ্তাহখানেক ধরে করোনার উপসর্গ নিয়ে বাচ্চা-কিশোরসহ সব বয়সী রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক অনেক বেশি। করোনা হলো কিনা— এটা নিয়ে অভিভাবকরা একটু বেশি আতংকিত। যেকোনো জ্বর হলেই তারা করোনা রোগী ধরে নিচ্ছেন। আসলে এটা সিজনাল রোগ। করোনা উপসর্গের সাথে প্রায় মিল থাকার কারণে বাবা-মা একটু আতংকিত হচ্ছেন। কিন্তু এই রোগ তো ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাচ্ছে সামান্য মেডিসিন বা ঘরোয়া সেবাযত্নের ফলে। যেসব রোগী বেশি সিরিয়াস, তাদের আমরা অক্সিজেন দিয়ে ট্রিটমেন্ট দিচ্ছি। তারাও অল্প দিনে ভালো হয়ে যাচ্ছে।’

এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘৫ থেকে ৭ দিন পরেও যদি সর্দি-কাশি কিংবা জ্বর না কমে, তখন করোনা টেস্ট করতে বলি। সেই টেস্টেও কিন্তু করোনা পজিটিভ হচ্ছে না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে এটা সিজন পরিবর্তনের ফলে হচ্ছে। এজন্য এত বেশি আতঙ্কিত বা চিন্তিত না হয়ে একটু সচেতন থাকলেই হবে। করোনা উপসর্গে কিন্তু সর্দি-কাশির লক্ষণ তেমন থাকে না। গত দুই সপ্তাহ ধরে যেসব রোগী পাওয়া যাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের সর্দি-কাশি আছে। এটা একটা সাধারণ রোগ।’

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বাসনা মুহুরী বলেন, ‘সিজন পরিবর্তনের সাথে বাচ্চাদের বেশি সর্দি-জ্বর হয়ে থাকে। সেজন্য অভিভাবকদের একটু সচেতন হতে হবে। কারণ এই সময়ে সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বরকে করোনা হিসেবে ধরে নিচ্ছেন অনেকে। সিজন পরিবর্তনের কারণে বাচ্চাদের সর্দি-কাশি-জ্বর হতেই পারে। এটা সাধারণ ব্যাপার। এটাকে করোনার সাথে মেলানো ঠিক হবে না। সেজন্য বাচ্চাদের পাশাপাশি ঘরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যতটুকু পারা যায় দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে হবে। বাচ্চা বা কিশোরদের খেলাধুলা বা ঘরের বাইরে যেতে হলে অবশ্যই মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে যেতে হবে। সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বর বলে আবার অবহেলাও করা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আরেকটা বিষয় হলো জ্বর হলে করোনার ভয়ে যেসব শিশুর ২ বছরের কম বয়স তাদের বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ না করে, পাশাপাশি অন্য খাবারও যেন খাওয়ানো হয়। সেই সাথে বাসায় যারা ধুমপান করে, তাদের কাছ থেকে অসুস্থ শিশুকে একটু দূরে রাখতে হবে। কারণ সে সময় বাচ্চাটি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। ধুমপায়ীর আশেপাশে বাচ্চা থাকলে সেই ধোঁয়ায় বাচ্চার শ্বাসনালী চেঞ্জ হয়ে যায়। তখন সর্দি-কাশি তারপর জ্বর এই জাতীয় ভাইরাস বেশি অ্যাটাক করে। এই বিষয়গুলো বাবা-মাকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি খাবারের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। শাকসবজি ও ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার খাওয়াতে হবে। দূরত্ব বজায় রেখে রোদে একটু হাঁটতে বা খেলতে দিতে হবে। যেন ভিটামিন-ডি এর ঘাটতি পূরণ হয়। তাতে করেও শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।’

নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডা. সঞ্জয় দাশ বলেন, ‘এখন রোগী অত্যন্ত বেশি। ১০ জনের মধ্যে ৬ থেকে ৭ জনেরই এই ধরনের সমস্যা আছে। এটা কোন নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা কিনা আসলে বোঝা যাচ্ছে না। করোনা রোগীর শরীরের যে চেঞ্জগুলো পাওয়া যায় এই রোগে কিন্তু আমরা তা পাচ্ছি না। করোনা টেস্ট করেও পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে সামান্য নরমাল ওষুধ ও ঘরোয়া সেবাযত্ন যেমন গরম পানি, লেবু পানি, লেবুর চা তাতেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠছে। তবে সেই ক্ষেত্রে কাশিটা থাকছে, কিছুদিন ভোগাচ্ছে এই কাশি।’

তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের উচিত আতংকিত না হয়ে একটু সচেতন হওয়া। যেখানেই যান না কেন মাস্ক পরে সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে হবে। সামাজিক অনুষ্ঠানে আপাতত না যাওয়াই ভালো। এই ধরনের অনুষ্ঠানে মানুষের আনাগোনায় দ্রুত অ্যাটাক করে। তাতে বাচ্চারা বেশি সংক্রমিত হচ্ছে।’

চটগ্রাম সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন সিজন পরিবর্তন হচ্ছে। কিছুদিন গরম, আবার বৃষ্টি, আবার গরম। তার ফলে সর্দি-কাশি-জ্বর এই রোগগুলো প্রতি ঘরে ঘরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই রোগগুলো নিয়ে সবাই আতংকিত হয়ে করোনা টেস্ট করাচ্ছে। কিন্তু কারও করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়নি। আমরা এটা সাধারণ রোগ মনে করছি। সেজন্য যারা আসছে তাদের বোঝাচ্ছি, ভয়ের কিছু নেই। নরমাল জ্বর হলে যেমন চিকিৎসা নেন, ঠিক তেমন চিকিৎসা নিন। তিনদিনে না কমলে তখন পরীক্ষা করাতে বলি। সেক্ষেত্রেও নেগেটিভ রেজাল্ট পাওয়া যায়।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে করোনা পরিস্থিতির শেষ ১০-১৫ দিনের তথ্য-উপাত্ত দেখলে বোঝা যায় করোনা পজিটিভের সংখ্যা ১০ শতাংশের নিচে ঘোরাফেরা করছে। মানুষ আগের চেয়ে একটু সচেতন হয়েছে এখন। আগে ১০০ জনের মধ্যে ৩০-৩৫ জন পজিটিভ পাওয়া যেত। এখন সেটা ৫-৬ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ৮ জন পজিটিভ পাওয়া গেছে। এটা একটা সাধারণ জ্বর। তাতে আতংকিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজন। করোনা কমে গেছে বলে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে এই রোগ আবার দ্রুত বাড়তে সময় লাগবে না।’

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডাঃ হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘এই রোগটি সিজনাল রোগ। এটা প্রতিবছরই হয়। এবার করোনার মধ্যে হওয়ায় সবার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে আবার আরেকটা নতুন ভাইরাস আসলো কিনা। এটা নিয়ে আতঙ্কের কিছু নাই। ৩-৪ দিন পর এমনিই সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রত্যেক ঘরে বাচ্চাসহ বয়স্ক সব বয়সীদের এই রোগটা হচ্ছে সিজন পরিবর্তনের কারণে। এটা নিয়ে কারও আতংকিত হওয়ার কিছু নাই। সাধারণ জ্বরের ওষুধ প্যারাসিটামল বা ঘরোয়া ট্রিটমেন্টে এই রোগ ভালো হয়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে করোনার বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশের অন্য জায়গার চেয়ে অনেক ভালো। দুইদিন আগেও করোনায় চট্টগ্রাম বিভাগে একজনও মৃত্যু ছিল না। এই মৃত্যু সংখ্যা প্রতিদিন ১-২ জনে এবং আক্রান্তের সংখ্যায় ৭-৮ জনে নেমে আসছে।’

এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!