মাজারভক্ত ‘মাইজভাণ্ডারী সোহেল’ই হয়ে ওঠে নব্য জেএমবির টার্গেট

জবাই করে লাশ ফেলা হয় গাজীপুরের নদীতে

বাবা ছিলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের অনুসারী। বাবার দেখাদেখি বড় ছেলেও বছরকয়েক আগে মাইজভাণ্ডারের মুরিদ হন। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বাড়িঘর ছেড়ে তিনি ঘুরতে থাকেন মাজারে মাজারে। একসময়ে এসে এটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো তার। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট আইএসের অনুসারী বাংলাদেশের নব্য জেএমবির একটি সেল তাকে ‘টার্গেট’ করে। গত ৩১ জুলাই ঈদের আগের রাতে নৃশংসভাবে জবাই করা হয় সোহেল নামের ওই যুবককে। মাজারে মাজারে সবাই তাকে চেনে ‘মাইজভাণ্ডারী সোহেল’ নামেই। নাড়িভুঁড়ি কেটে পাথর বেঁধে সেই যুবকের লাশ ফেলে দেওয়া হয় নদীতে।

আইএসের ধরনে জবাই করার ওই ভিডিও ধারণ করে সেটি নিজেদের একাধিক চ্যানেলে প্রচার করা হয়। গত ১৬ আগস্ট আইএস আনুষ্ঠানিকভাবে এই হত্যার দায় স্বীকার করে। আইএসের মিডিয়া সেলের বরাতে বিশ্বজুড়ে জঙ্গি তৎপরতার নজরদারি সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ নিহত সোহেলের একাধিক ছবিও প্রকাশ করে সে সময়।

গত ২৪ জুলাই রাজধানীর পল্টনে একটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এর সঙ্গে নব্য জেএমবির নতুন একটি গ্রুপের সন্ধান পান ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কর্মকর্তারা। নব্য জেএমবির এই গ্রুপটি নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে সিটিটিসির একটি দল গত শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর) ঢাকার উত্তরার আজিমপুর থেকে মামুন আল মুজাহিদ ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রহমান, আল আমীন ওরফে আবু জিয়াদ, মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে রোকন ওরফে আবু তারিক ও সারোয়ার রহমান রাহাত নামের চার তরুণকে গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদে এই চার জঙ্গি পল্টনে বোমা বিস্ফোরণে জড়িত থাকার পাশাপাশি গাজীপুরের ‘মাইজভাণ্ডারী সোহেল রানা’কে জবাই করে হত্যার কথা স্বীকার করে।

মাজারভক্ত ‘মাইজভাণ্ডারী সোহেল’ই হয়ে ওঠে নব্য জেএমবির টার্গেট 1

জানা গেছে, অনুসারী চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারের হলেও নিহত সোহেল রানার বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার শিলসি গ্রামে। তার বাবা আবুল কাশেম চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের অনুসারী। কয়েক বছর আগে সোহেল রানাও মাইজভাণ্ডারের মুরিদ হন। স্ত্রীর সঙ্গে বছরকয়েক আগে বিচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে সোহেল বিভিন্ন মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়াতেন। পেট চালানোর জন্য বিক্রি করতেন তাবিজ, সুতা, পাথর ইত্যাদি। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা গত আড়াই মাস ধরে সোহেলের মোবাইল ফোন বন্ধ পাচ্ছিলেন। কোরবানির ঈদের আগের দিন ৩১ জুলাই বাবার সঙ্গে সোহেলের সর্বশেষ কথা হয় মোবাইলে। ঘটনাচক্রে ওই দিনই জবাই করা হয় মাইজভাণ্ডারী সোহেলকে।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ট ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) হাতে গ্রেপ্তার হওয়া চার জঙ্গি জিজ্ঞাসাবাদে জানান, চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে নব্য জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান নাইমুজ্জামানের হাত ধরে নব্য জেএমবিতে যোগ দেন তারা। কিন্তু শুরুতেই একটি টার্গেট ফিক্সড করে আইএসের ধরনে ওই টার্গেটকে হত্যার নির্দেশনা দিয়ে সংগঠনে নিজেদের ‘যোগ্যতা’ প্রমাণ করার জন্য তাগাদা দেন নাইমুজ্জামান। এজন্য আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয় তাদের। এই ‘টার্গেট’ ফিক্সড করতে গিয়ে তাদের নজর পড়ে মাজারে মাজারে ঘোরা সোহেল রানার ওপর। তবে শুরুতে তাকে হত্যা করা নিয়ে তারা দ্বিধাগ্রস্থ ছিল। কিন্তু জিলহজ মাসের ১০ তারিখ কাছাকাছি এসে যাওয়ায় চার জঙ্গি মাইজভাণ্ডারী সোহেলকেই টার্গেট হিসেবে চূড়ান্ত করে।

গত ৩১ জুলাই ছিল জিলহজ মাসের ১০ তারিখ। ওইদিন সন্ধ্যায় তারা কবিরাজি চিকিৎসার কথা বলে সোহেলকে গাজীপুরের শ্রীপুরের বড়মি বাজারের কাছে একটি ইটভাটায় নিয়ে যান। সেখান থেকে বিষয়টি তারা জানান নব্য জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান নাইমুজ্জামানকে। তিনি সোহেলকে দ্রুত জবাই করে ফেলার নির্দেশ দেন অনুগত চার জঙ্গিকে।

এরপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামার পর জবাইয়ে অনভ্যস্ততার কারণে চার জঙ্গি মিলে একবার সোহেলকে শরবতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পরিকল্পনা নেন। কিন্তু সোহেল রানা সেই শরবত খেতে না চাওয়ায় তার হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়। এর কিছুক্ষণ পর জঙ্গি মামুন আল মুজাহিদ ওরফে সুমন নিজ হাতে সোহেলকে জবাই করেন। পুরো বিষয়টি এ সময় মোবাইল ফোনে ভিডিও করে নাইমুজ্জামানের কাছে পাঠানো হয়। এরপর সোহেলের পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে শরীরের সঙ্গে ইট বেঁধে একটি বস্তায় ভরা হয়। সকালে একটি নৌকায় করে কাপাসিয়া ব্রিজের কাছে গিয়ে লাশভরা বস্তাটি নদীতে ফেলে দেয় ওই চার জঙ্গি।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা এখন জঙ্গিদের দেওয়া তথ্য যাচাই করে নিহত সোহেলের লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) থেকে সোহেলের লাশ উদ্ধারের জন্য পুরোদমে অনুসন্ধান চলছে গাজীপুরে। যে নৌকায় করে কাপাসিয়া ব্রিজের কাছে লাশটি ফেলা হয়েছিল, ইতিমধ্যে সেই নৌকার মাঝিকেও শনাক্ত করা হয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!