কর্ণফুলীর আর কোন ক্ষতি হতে দেয়া যাবে না: ভূমিমন্ত্রী

হাইকোর্টের নির্দেশনার কারণে মাঝপথে উচ্ছেদ বন্ধ

এ বছরের শুরুতে উচ্চ আদালতের রায় ঘোষণার প্রায় আড়াই বছর পর নদীর পাড়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক কোটি ২০ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তবে সে সময় অর্থ না পাওয়ায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়নি। পরে ভূমি মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অর্থ সংস্থানের পর অভিযান শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ সে অভিযানও বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে চলতি বছরে ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর হাইকোর্টে রিট ও ১২টি মামলার কারণে কর্ণফুলী নদী দখলমুক্ত করার প্রক্রিয়া থেমে আছে। কর্ণফুলী নদী দখল-দূষণমুক্তসহ অবিলম্বে ক্যাপিটাল ড্রেজিং’—শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় সে প্রসঙ্গে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, ‘অব্যাহত দখলের পর কর্ণফুলী নদী এখন যে অবস্থায় আছে, আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, এই নদীর আর কোনো ক্ষতি করার সুযোগ কাউকে দেওয়া যাবে না। আমি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আর.এস. মূলে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদী উদ্ধারের কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু আইনের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, মাঝপথে হাইকোর্টের নির্দেশনার কারণে সব বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমি চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে প্রত্যাশা করছি যে, এই নদীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তারা এগিয়ে আসবেন।’

এছাড়াও দখল ও দূষণ রোধ এবং কর্ণফুলী নদী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে স্থায়ী রূপরেখা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। একই সাথে কর্ণফুলী রক্ষায় চট্টগ্রাম বন্দরকে আরও সক্রিয় হওয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

শনিবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে নগরীর অভয়মিত্র ঘাটে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের ২১ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। নদী রক্ষার এই আলোচনায় চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়াল অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘চ্যানেল আই চট্টগ্রাম অফিস’ এই আলোচনার আয়োজন করে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের উদ্দেশে ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি জানি, আপনারা অনেক কাজ করেন। কিন্তু আশা করব আরও সক্রিয় হবেন। আরও জোরালোভাবে অভিযান পরিচালনা করেন। মন্ত্রী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে আছি। আমি আজ মন্ত্রী আছি, কাল নাও থাকতে পারি। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আছে, যেহেতু আমি চট্টগ্রামের সন্তান। কথা দিচ্ছি, সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।’

বন্দর চেয়ারম্যানের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘ব্রিজ হোক, সমস্যা নেই। এখন তো অনেক ধরনের প্রযুক্তি এসে গেছে। যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেই ব্রিজ হোক না কেন, নিচে যে পলি জমা হবে, সেটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। ছোট ছোট টেন্ডারের মাধ্যমে সেগুলো অপসারণ করতে হবে। এখন মাটির চাহিদা আছে। বালির দাম সোনার চেয়েও বেশি।’

আলোচনায় কর্ণফুলীর স্থায়ী রূপরেখা তৈরির নির্দেশনা দিয়ে বন্দর চেয়ারম্যানের উদ্দেশে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘দখল ও দূষণ রোধ করা এবং এই নদীর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ বন্দরের প্রাণ কর্ণফুলী নদী। আপনি বন্দর ব্যবহারকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসেন। একটা স্থায়ী রূপরেখা তৈরি করেন। আপনি আজ চেয়ারম্যান আছেন, কাল না-ও থাকতে পারেন। কিন্তু পরবর্তী চেয়ারম্যান এসে যাতে এই রূপরেখা অনুসরণ করতে পারেন। ড্রেজিংটা নিয়মিত করতে হবে, সেজন্য একটা রূপরেখা তৈরি করুন।’

কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট অংশে নতুন সেতু নির্মাণের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কালুরঘাটে যে সেতুটা আছে, সেটা অনেক পুরানো। এখন যেহেতু ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন যাচ্ছে, আরেকটা সেতু অবশ্যই প্রয়োজন। বোয়ালখালীবাসীর দাবি আছে, সড়কসহ যেন সেতু হয়। সেটাও হতে পারে, কোনো সমস্যা দেখছি না। কিন্তু কথা একটাই, পিলারের কাছে যে পলি জমা হবে, সেগুলো নিয়মিত অপসারণ করে নেভিগেশন ঠিক রাখতে হবে।’

কর্ণফুলী নদীজুড়ে লাইটারেজ জাহাজ ছড়িয়ে থাকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, ‘সাগরে অনেক জায়গা। লাইটারেজ জাহাজগুলো নদীতে কেন পার্ক করে রাখা হবে। আগে দেখতাম শুধু খারাপ আবহাওয়া হলে লাইটারেজগুলো নদীতে এনে রাখা হত। এখন তো সারাবছর ফিরিঙ্গিবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত লাইটারেজ জাহাজ রাখা হচ্ছে। এতে তো বন্দরে বড় জাহাজ চলাচলে সমস্যা হয়। নেভিগেশনের সমস্যা হয়।’

কর্ণফুলীর আর কোন ক্ষতি হতে দেয়া যাবে না: ভূমিমন্ত্রী 1

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়াল অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীতে এক নম্বর জেটি অর্থাৎ নিচের দিকে নাব্যতা অনেক বেড়েছে। এখন ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসছে। কিন্তু উপরের দিকে নাব্যতা কমেছে। আমরা নিয়মিত ড্রেজিং করছি বলেই নাব্যতা বেড়েছে। উপরের দিকে পারছি না, সেখানে অনেক প্রতিবন্ধকতা। সেখানে নদীর তলদেশে মাটি নেই, সব আবর্জনা, পলিথিন। প্রতিদিন টনে টনে বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। আমরাও একমত যে কর্ণফুলী নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে, যত খরচই লাগুক। এ বিষয়ে একটি মনিটরিং কমিটি করা যায়। এ কমিটিকে আর্থিক স্বাধীনতা দিতে হবে।’

জাহাজ চলাচলের সুবিধায় কর্ণফুলী নদীর বাঁকগুলো সোজা করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী আঁকাবাকা। এটাকে স্ট্রেইট করতে না পারলে জাহাজ চলাচলে সমস্যা থেকে যাবে। আমরা স্টাডি করছি। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা যেটা হচ্ছে, অনেককিছুই ভাঙতে হবে। কারখানাগুলো কোথায় প্রতিস্থাপন করা হবে, তাদের যেন ক্ষতি না হয় সেটাও আমাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে। সীমানা নির্ধারণ করা, এটা আরেকটা প্রতিবন্ধকতা।’

বক্তব্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী দিয়ে দেশের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। ৪০০-৫০০ বছর আগে কর্ণফুলী ছিল কোর্ট বিল্ডিংয়ের নিচে। ক্রমে দক্ষিণে সরে এসেছে। সরকারের টাকা আছে। কর্ণফুলী বাঁচাতে যদি ৬ মিটার খনন করতে হয় তবে উন্নত ড্রেজার আনতে হবে। দেশের মানুষের মধ্যে আইন না মানা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যাতে আইন মানে।

আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, ‘পলিথিন সরকার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আসছে কোথা থেকে। পলিথিনের উৎস কারখানা। সেখানে বোমা মারলে উড়ে চলে যাবে। কারখানায় তালা মারলে হবে না। একেবারে উচ্ছেদ করতে হবে। আমরা আসলে উৎসটা ধরি না।’

বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি এমএ সালাম বলেন,‘ কর্ণফুলী সুন্দর রাখতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। পাহাড় খেয়ে ফেলেছি আমরা। কর্ণফুলী খেয়ে ফেললে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিল্প বাড়বে, এটা বন্ধ করা যাবে না। শিল্পকে সবুজ করার জন্য ব্যবসায়ীদের কমিটমেন্ট থাকতে হবে।’

হালদা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘কর্ণফুলীর পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও দূষণ বন্ধে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমন্বয় জরুরি। চসিক, সিইউএফএল, কেপিএম ও ওয়াসাকে দূষণ বন্ধে উদ্যোগী হতে হবে। কালুরঘাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ফেরি সার্ভিস চালু করলে নগরের অর্ধেক যানবাহন কমে যাবে।’
চলতি বছরে ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর হাইকোর্টে রিট ও ১২টি মামলার কারণে কর্ণফুলী নদী দখলমুক্ত করার প্রক্রিয়া থেমে আছে বলে জানান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন।

গোলটেবিল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন সম্পাদক আলীউর রাহমান। চ্যানেল আই চট্টগ্রাম অফিসের প্রধান চৌধুরী ফরিদের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও অংশ নেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া, পরিবেশ গবেষক ইদ্রিস আলী, ব্যবসায়ী নেতা এস এম আবু তৈয়ব ও এম এ সালাম, স্থপতি আশিক ইমরান, সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রহুল আমিন, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব প্রমুখ।

এসআর/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!