করোনায় চট্টগ্রামের ফ্যাশন হাউজগুলোর পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে

‘সব টাকা কাপড় হয়ে গেছে’

‘আমার কর্মচারী ফোন করে বলে, স্যার, আমাদের স্যালারির কী হবে? আমরা না খেয়ে আছি। এখন আমাদের কথা হচ্ছে আমরা কী করব? আমাদের সব টাকা কাপড় হয়ে গেছে। আমার কাছে এখন টাকা নাই। দেবো কোত্থেকে? ওরা (কর্মচারী) টাকা পাবে, ওদের দেওয়া উচিত। কিন্তু আমার কাছে নাই, আমি কী করব?’— এভাবেই নিজের বর্তমান অবস্থার কথা বলছিলেন ফ্যাশন হাউজ ‘শৈল্পিকের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক এইচএম ইলিয়াস।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় পড়াশোনা শেষ করে, এই উদ্যোক্তা নিজের উদ্যোগে ২০০৪ সালে ছোট আকারে ফ্যাশন হাউস ‘শৈল্পিক’ গড়ে তুলেছিলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই সাফল্য পেয়ে যান। ধীরে ধীরে কাজের পরিসর বেড়ে শৈল্পিকের ১৬টি আউটলেটে (শোরুম) প্রায় ৬০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। শৈল্পিকের মতোই চট্টগ্রামের নামি-দামি ফ্যাশন হাউস বা বুটিক হাউসগুলো পহেলা বৈশাখ আর ঈদ এবার কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় এই দুটি উৎসবকে কেন্দ্র করে জমজমাট ব্যবসার প্রস্তুতি নিয়েছিল। দেশীয় ফ্যাশন হাউসের তৈরি পোশাকের সাথে আরও যোগ আছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। কিন্তু অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির এ খাতগুলোতে হঠাৎ ভয়াবহ থাবা বসিয়েছে করোনাভাইরাস।

চট্টগ্রামের শীর্ষ ফ্যাশন ডিজাইনাররা একসঙ্গে। বছরখানেক আগের কথা।
চট্টগ্রামের শীর্ষ ফ্যাশন ডিজাইনাররা একসঙ্গে। বছরখানেক আগের কথা।

গত ৮ মার্চের পর পহেলা বৈশাখে ফ্যাশন হাউজগুলোর বেচাকেনা করোনার থাবায় থেমে গেলেও উদ্যোক্তাদের আশা ছিল অন্তত ঈদে ব্যবসা করবে। সে আশাও অনেকটা গিলে নিয়েছে করোনা। বর্তমানে অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে অন্য সব শিল্পখাতের মতো এ খাতেও চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে উদ্যোক্তারা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আনুমানিক ৫০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে চট্টগ্রামের দেশীয় ফ্যাশনশিল্প খাত। তীব্র সংকটে পড়বে প্রায় দুই হাজার ৫০০ উদ্যোক্তা। একই সাথে বিপদে পড়বে এ খাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল অসংখ্য মানুষ।

এ প্রসঙ্গে এইচএম ইলিয়াস চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের যা টাকা-পয়সা মূলধন ছিল ঈদ এবং পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে তার সবটা বিনিয়োগ করে কাপড় বানিয়েছি। ব্যবসা করার সময় থেকে এরকম পরিস্থিতিতে কখনও পড়িনি। আমাদের সাথে অনেকগুলো সেক্টর জড়িত। তাদের অবস্থাও শোচনীয়। অনেক সময় তারা আমাদের বাকিতে মালামাল দেয়। আমরা বেচাবিক্রির পর লাভ করে তাদের দিয়ে দেই। এখন আমাদের সব বন্ধ। দোকান বন্ধ থাকলেও বাড়িভাড়া, ইউটিলিটি বিল, ঋণের কিস্তি, স্টাফদের বেতন, ভ্যাট, ট্যাক্সসহ সব দিতে হবে। দোকান ভাড়াও অনেক গুণতে হচ্ছে। কিন্তু ব্যবসাই তো করতে পারলাম না। এসব দেবো কী করে?’

হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ২০ দিন বা অন্তত ১০ দিনও সময় পাই, তাহলে কিছুটা ব্যবসা হলে খেয়ে পরে বাঁচতে পারব। বছরের অন্য সময় বলতে গেলে খুবই সামান্য সেল হয়, তখন প্রফিট আসে না। কোনোমতে চালিয়ে নেওয়া যায়। অনেক সময় ধার হয়ে যায়। গোটা ১১ মাসে যা কাজ হয়, তা রমজানেই উঠে আসে।’

বন্দরটিলা থেকে শুরু করে অক্সিজেন পর্যন্ত ১৬টি আউটলেট শৈল্পিকের। কারিগরসহ মোট কর্মচারী প্রায় ৬০০ জন। প্রতি মাসে দোকান ভাড়া গুণতে হয় ৩০ লাখ। সরকারকে দুভাবে ট্যাক্স দেয় ১০ লাখ টাকা। এছাড়া প্রতি মাসে ভ্যাট দেয় তিন লাখের বেশি। শুধু শৈল্পিক থেকে সরকারের আয় ৩০ লাখের ওপরে।

কেবল শৈল্পিক নয় চট্টগ্রামের অন্যান্য ফ্যাশন হাউসগুলোও নিজেদের সঞ্চয়ের পাশাপাশি ব্যাংক থেকে নেওয়া অর্থ, এমনকি নানাভাবে সংগৃহীত পুঁজির সবটাই বিনিয়োগ করেছে পহেলা বৈশাখ আর ঈদকে কেন্দ্র করে। এখন থমকে গেছে অসমাপ্ত কাজ। আটকে গেছে উদ্যোক্তাদের সম্পূর্ণ পুঁজি। বিপরীতে আয় না হলেও দ্বিগুণ বেড়েছে খরচ। ক্ষতির পরিমাণে শেষ পর্যন্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকার দশা হয়েছে চট্টগ্রামের ফ্যাশনশিল্পের। আর দেশীয় ফ্যাশনশিল্পের সংকট মানে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব খাতের সার্বিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া।

ফ্যাশন হাউস আর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা দেশে আমার ১৫টা আউটলেট। চট্টগ্রামেই পাঁচটা। বৈশাখ আর ঈদকে সামনে রেখে প্রায় ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট করা হয়ে গেছে। তাছাড়া রোজার প্রোডাক্ট পরে আর বিক্রি করতে পারবো না। যার পুরোটাই লস প্রজেক্ট। প্রণোদনার তহবিল থেকে প্রদত্ত ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে। বাকি ৪ শতাংশ দিতে হবে আমাদের। যদি তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয় তাহলে মাত্র ১৭ লাখ টাকা দিয়ে একজন ব্যবসায়ী তিন কোটি টাকার লস সামাল দিবে কিভাবে! কারণ প্রাইভেট ব্যাংকের ওপর দায়ভারটা রয়েছে। তিন বছর পর সরকার তাদের থেকে নেবে। এ কারণে তারা (ব্যাংক) চিন্তা করবে তাদের নিরাপত্তা আগে। এই প্রণোদনাটা সরকারের নিজের থেকে সরাসরি দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কারণ এই প্রণোদনা এখন কেউ পাবে, কেউ পাবে না।’

চট্টগ্রামের ডিজাইনার্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা রওশন আরা চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বছরজুড়ে আমাদের টার্গেট পহেলা বৈশাখ আর ঈদ। এ দুটোকে কেন্দ্র করে আমাদের টোটাল ইনভেস্টমেন্ট এবং এ দুটো থেকেই আমাদের আশানুরূপ সেল আসে। আমরা ছোটখাটো ব্যবসায়ী। ব্যাংক লোন বা হ্যান্ড লোন নিয়ে প্রায় ছয় সাত মাস আগে থেকেই এবারের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু টোটাল ইনভেস্টমেন্ট জলে গেল। বৈশাখের প্রোডাক্টগুলো আমি আর নেক্সট ইয়ার সেল করতে পারব না। এভাবে পড়ে থাকবে। আবার ঈদের প্রোডাক্টের যাদের অর্ডার ছিল তারাও ক্যানসেল করে দিয়েছে। দেশের বাইরের প্রচুর অর্ডার ছিল, সব বাতিল হয়ে গেছে। আউটলেট খোলা থাকলে কিছু না কিছু সেল থাকতো। আর এখন তাও নেই। একেবারে মরে গেলাম। জানিনা আর কন্টিনিউ করতে পারব কিনা।’

ক্ষতির পরিমাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওভারঅল বলতে গেলে আমার প্রায় ৪০ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। সবকিছু বাদ দিয়ে এই ধাক্কা সামলাতে পারবো না। ২০১৭ সালে সিডিএ ওয়াটার লকডাউনের কারণে যে ক্ষতিটা হয়েছে ওটা এখনো সামাল দিয়ে উঠতে পারিনি। তারপর এখন আবার এত বড় ধাক্কা। সিক (অসুস্থ) হয়ে গেছি।’

এর সাথে যোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ট্রেনিং ওয়ার্কার যারা আছে, তারা বেতন না পেলে অন্য কোথাও চলে যাবে। তাদের তো বাঁচতে হবে। একজন ট্রেইন্ড ওয়ার্কার (প্রশিক্ষিত দক্ষ কর্মী) রেডি করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। সেটা একটা বড় ক্ষতি আমাদের জন্য। সবকিছু মিলিয়ে ফ্যাশনশিল্প অনেক বড় একটা সেক্টর। প্রতিবছর এই সেক্টরে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। পুরো ইন্ডাস্ট্রি এখন পথে বসার মতন অবস্থা।’

মিয়াবিবি ফ্যাশন হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতানা নূরজাহান রোজি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা বছর টুকটাক ব্যবসা করি। বৈশাখ আর ঈদকে মাথায় রেখেই মূলত আমাদের ব্যবসা হয়। সেখানে বৈশাখে কিছু করতে পারলাম না। ঈদকেও পাচ্ছি না। আমাদের এত প্রোডাক্ট, এত প্রোডাকশন সব রয়ে গেল। সামনের বার এসব ডিজাইন চেঞ্জ হয়ে যাবে। এগুলোর কিছুই সেল হবে না। আবার আমাদের ৫০ জন স্টাফ যারা আছে, তাদের কী হবে? বলতে গেলে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমরা। এরকম পরিস্থিতি কখনো কল্পনাও করিনি।’

কৃষ্টি বুটিক হাউসের উদ্যোক্তা নূজহাত নূয়েরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অবস্থা আসলে মোটেও ভালো না। আমার সব কাঁথার স্টিচের প্রোডাক্ট। লেভারের ওপর ডিপেন্ড করে প্রোডাকশনে আনতে হয়। মেশিনের ওপর না। পহেলা বৈশাখ আর ঈদের কালার কম্বিনেশন একেবারে আলাদা। সেক্ষেত্রে বৈশাখের সব কালেকশন উঠিয়ে ফেলেছি। কামিং ইয়ারগুলোতে পহেলা বৈশাখ পাচ্ছি না তাই এবারের পুরোটাই জলে গেলো। এ লস মেনে নিলাম। কিন্তু ঈদে কী করব? প্রফিটও বিনিয়োগ করে ফেলছি। আমার কর্মীরা স্যালারি অবশ্যই পাবে এবং পেয়েছে। কিন্তু বোনাস দিতে পারবো না। সে ক্ষমতা আসলে আমার এই মুহূর্তে নেই।’

এদিকে গত ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বিশেষ তহবিলের ঘোষণা দিয়েছেন। এই তহবিল থেকে প্রদত্ত ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে। বাকি ৪ শতাংশ দিতে হবে উদ্যোক্তাদের।

রওশন আরা চৌধুরী বলেন, ‘ফ্যাশনশিল্পে দীর্ঘমেয়াদী এবং সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হোক। আমি বলছি না সারাজীবন আমাদের টানুক। কিন্তু একটা বছর যদি সুদ, ভ্যাট, ট্যাক্স এসব মওকুফ করা হয় এবং ঋণ যদি দীর্ঘমেয়াদী করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে হয়তোবা আমরা ঘুরে দাঁড়াবো। সবকিছুতে সরকার প্রণোদনা, সুদমুক্ত ঋণ দিচ্ছে। তাহলে আমরা কেন বাদ যাবো? আমাদের এই সেক্টরের সাথে অনেক মানুষের জীবন জীবিকা জড়িয়ে আছে।’

ফ্যাশন হাউসগুলোও পুঁজির সবটাই বিনিয়োগ করেছে পহেলা বৈশাখ আর ঈদকে সামনে রেখে
ফ্যাশন হাউসগুলোও পুঁজির সবটাই বিনিয়োগ করেছে পহেলা বৈশাখ আর ঈদকে সামনে রেখে

ফ্যাশন হাউস আর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন চৌধুরী বললেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানিগুলোকে তাদের সেলস ভ্যাটের ওপর ভিত্তি করে প্রণোদনা দেওয়া উচিত। তাহলে কেউই প্রণোদনা থেকে বাদ যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। সেলস ভ্যাটের ওপর নির্ভর করে সরকার যদি প্রণোদনা বন্টন করে, তাহলে এই সেক্টরে উদ্যোক্তারা এত বিশাল পরিমাণ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হয়তো পারবেন। এখন সরকার প্রণোদনা প্রাইভেট ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এসব প্রসেসিং করতে করতে আমরা সবাই মরে যাব। আমরা একজন লুজার হওয়া কোন বিষয় না। কিন্তু আমাদের সাথে অনেক পরিবার জড়িত আছে। এভাবে করতে করতে একসময় সারা বাংলাদেশ বেকারত্বের রাজ্য হয়ে যাবে।’

মিয়াবিবি ফ্যাশন হাউজের নূরজাহান রোজি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু আমাদের হাতে এসে পৌঁছে কিনা বা কখন এসে পৌঁছাবে, ওইটা একটা বিষয়। উনি (প্রধানমন্ত্রী) দিয়েছেন কিন্তু আমরা কখন পাচ্ছি? আমরা কতটুকু পাব? আমাদের হাতে এসে আদৌ পৌঁছাবে কিনা সেটা ভাবনার বিষয়। নইলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না। আমাদের সাথে অনেক লোকের কর্মসংস্থান জড়িত, তারাও অসহায় হয়ে যাবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!