করোনাকালের পুকুরচুরি যেভাবে ধরা পড়ল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে

৭০০ টাকায় থার্মোমিটার, ১৮০০ টাকায় হ্যান্ড গ্লাভস

যে থার্মোমিটারের বাজারমূল্য মাত্র ৩৫০ টাকা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে সেটা কেনা হয়েছে দ্বিগুণ মূল্যে— ৭০০ টাকায়। এভাবে ৯৫০ টাকার হ্যান্ড গ্লাভসও প্রতিটি কেনা হয়েছে দ্বিগুণ মূল্যে—১৮০০ টাকায়। অন্যদিকে ২৮০ টাকার প্রতিটি বেডশিট কেনা হয়েছে প্রায় তিন গুণ মূল্যে— ৭০০ টাকায়। ৩৫০ টাকার রাবারশিট কেনা হয়েছে প্রায় চার গুণ মূল্যে— ১২০০ টাকায়। একইভাবে ৪০ টাকার মগও কেনা হয়েছে প্রায় চার গুণ মূল্যে— ১৫০ টাকায়।

এসব পণ্য প্রচলিত বাজারমূল্যে সরবরাহের জন্য নামি একটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দিলেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) দুই থেকে চারগুণ বেশি দামে সেই মালামাল কিনেছে ‘এবি কর্পোরেশন’ নামের এক প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রতিষ্ঠানটি ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ টাকার মালামাল সরবরাহ করে চসিককে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে অনিয়ম অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটি দুর্নীতির এমন সব তথ্য খুঁজে পেয়েছে।

গত ২১ জুন চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের সিটি কনভেনশন হলে চট্টগ্রাম সিটি করর্পোরেশনের উদ্যোগে চালু করা হয় ২৫০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার। গত ১৩ জুন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এর উদ্বোধন করেন। তবে গত ১ জুন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সভাপতিত্বে এই আইসোলেশন সেন্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এর কোনো লিখিত রেজুলেশন রাখা হয়নি।

চিকিৎসা নিয়ে নগরজুড়ে হাহাকারের মাঝেও সেখানে রোগী না যাওয়ায় ৫৫ দিনের মাথায় আইসোলেশন সেন্টারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ ১০ আগস্ট সেখানে ৪ জন রোগী ভর্তি হয়। জানা গেছে, ওই ৫৫ দিনে ১২০ জন রোগীর জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ হিসেবে মাথাপিছু প্রতিজন রোগীর পেছনে খরচ হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা। সেন্টারটিতে ১৬ জন চিকিৎসকসহ বিভিন্ন বিভাগ থেকে পদায়ন করা ৯৭ জন কর্মরত ছিলেন।

চিকিৎসাখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামান্য ওষুধ ও অক্সিজেন সেবায় এর ভগ্নাংশও খরচ হওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে এর বিপরীতে তুলনামূলক জটিল করোনা রোগী সামাল দিয়েও হালিশহরে কিছু তরুণের উদ্যোগে পরিচালিত ‘আইসোলেশন সেন্টার চট্টগ্রামে’ রোগীপ্রতি খরচ হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ১৭৮ টাকা। তিন মাসে অনুদাননির্ভর ওই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেয় ৭৬৫ জন রোগী। সবমিলিয়ে সেখানে খরচ হয়েছে মাত্র ৪৭ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা।

এদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত আইসোলেশন সেন্টারটি নিয়ে বিতর্ক উঠার পর গত ১৮ আগস্ট চসিক প্রশাসক খোরশেদুল আলম সুজন অনিয়ম তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এতে চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়াকে আহবায়ক, হিসাবরক্ষক মাসুদুল ইসলামকে সদস্য সচিব এবং প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আকতার চৌধুরীকে সদস্য করা হয়।

এই কমিটি যান্ত্রিক শাখার ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক, ডা. সুশান্ত বড়ুয়া, প্রকৌশলী সালমা, বিদ্যুৎ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার, স্টোরের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী ও নেজারত শাখার একজনসহ সবার কাছ থেকে লিখিত আকারে আইসোলেশন সেন্টারের কেনাকাটা ও খরচের তথ্য তলব করে।

রোববার (৪ অক্টোবর) তদন্ত কমিটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছেন। এই তদন্তে দেখা গেছে, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের সময়ে গড়া এই আইসোলেশন সেন্টারের জন্য মালামাল কেনায় কোনো বিধিই মানা হয়নি। এক্ষেত্রে করোনা পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থার বাহানা দেওয়া হলেও বাস্তবে কাজ পেয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানই। অথচ একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে দরপত্র নেওয়া হলে সর্বনিম্ন দরদাতাই কাজ পেতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ‘তাজ সার্জিকাল মার্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রচলিত বাজারমূল্য অনুযায়ী মালামাল সরবরাহের দরপত্র দিলেও চসিক দুই থেকে চারগুণ বেশি দামে সেই মালামাল কিনেছে ‘এবি কর্পোরেশন’ নামের এক ‘পছন্দের’ প্রতিষ্ঠান থেকে। চালাকি করে মালামালগুলো আবার কেনা হয়েছে দুই লটে।

জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশনের ওই আইসোলেশন সেন্টারের সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন যান্ত্রিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক। শুরুতেই দরপত্রবিহীন ২ কোটি টাকার বেশি খরচ দেখানো ছাড়াও হিসাবের গরমিলসহ নানা অভিযোগ উঠে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইসোলেশন সেন্টারটিতে মোট ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ ৬ হাজার ৪৪৭ টাকা। এর মধ্যে সরঞ্জাম কেনা বাবদ ব্যয় ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ টাকা। মাস্ক কেনা হয়েছে ৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকার। ওষুধ কেনা হয়েছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫০ টাকার। ইন্টারনেট ও টেলিভিশন কেনায় খরচ হয়েছে ৭ লাখ ২২ হাজার ৩০০ টাকা। এসিসহ আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বাবদ ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৫৩ টাকা।

অন্যদিকে আইসোলেশন সেন্টারের ‘সংস্কার কাজে’ খরচ হয়েছে ২৬ লাখ ৬১ হাজার ৯৯৯ টাকা। খাবারসহ স্টেশনারি মালামাল কেনায় ব্যয় হয়েছে ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৯৯৫ টাকা। এর বাইরে অনুমোদন ও কার্যাদেশ ছাড়া কেনা হয়েছে আরও কিছু মালামাল।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের করোনা আইসোলেশন সেন্টারের জন্য মুরাদপুরের এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক থেকে ৩ লাখ ৭ হাজার ২৫০ টাকার পণ্য কেনা হয়। এর মধ্যে প্রতিটি ২ হাজার ৪৫৮ টাকা মূল্যে ২৫০ পিস স্মার্ট সু বক্স কেনার কথা বলা হলেও চসিকের কন্ট্রোলার অব স্টোরস বিভাগ কার্যাদেশ দেখাতে পেরেছে মাত্র ১২৫ পিসের। আলিফ অ্যাড ব্যাংক নামের এক অখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে তিন হাজার পিস ‘কেএন-৯৫ মাস্ক’ কেনা হয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা দিয়ে। প্রতিটি মাস্কের দাম পড়েছে ৮৮ টাকা। গ্ল্যামার কিডস নামের আরেক অখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০ পিস ‘এন-৯৫ মাস্ক’ কেনা হয়েছে প্রতিটি ৯২০ টাকা মূল্যে।

অন্যদিকে আইসোলেশন সেন্টারের জন্য ৫৩টি অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও তদন্ত কমিটির এর মধ্যে মাত্র ৫০টি সিলিন্ডারের খোঁজ পেয়েছে। এছাড়া ১০টি ওয়াকিটকি কেনা হলেও আইসোলেশন সেন্টারের মালামালের তালিকায় সেগুলো অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ— টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের আইসোলেশন সেন্টার যে খরচ দেখিয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবাখাতে এ ধরনের খরচের নজির খুব বেশি নেই। দেশের ক্রান্তিকালীন সময়ে এ ধরনের জঘন্য চুরি মোটেই সমীচীন নয়। এটা বহুল আলোচিত বালিশ কেলেংকারিকেও হার মানিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চসিকের সামান্য ওষুধ ও অক্সিজেন সেবায় খুব বেশি খরচ হওয়ার কথাও নয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!