ইসমাম, শাহরিয়ার ও সর্বশেষ হাবিব। তিনজনেরই বয়স ১২-১৩ বছর। তিনজনই ‘কুরআনে হাফেজ’ হতে এসেছিল। নগরীতে কুরআন শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে এসে ‘হাফেজ’ না হয়ে লাশ হল তারা। অস্বাভাবিক মৃত্যুর তিন ঘটনাতেই নিহতের স্বজনরা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। তিন ঘটনাতেই আছে নির্যাতনের অভিযোগ। তবে একটি ঘটনাতেই কেবল হত্যামামলা দায়ের হয়েছে।
হাবিবের হাঁটুতে আঘাতের তাজা চিহ্ন
বায়েজিদ থানার ওয়াজেদিয়া এলাকার আবু বক্কর সিদ্দিক আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় পড়তেন হাবিবুর রহমান। ১১ এপ্রিল ২০১৯ (বৃহস্পতিবার) মাদ্রাসা থেকেই ১২ বছর বয়সী এই ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হাবিব খাগড়াছড়ির দীঘিনালার অনাথ আশ্রম এলাকার আনিসুর রহমানের ছেলে।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কফিল উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বুধবার রাতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আমার বাসায় এসে জানান হাবিবুর রহমান নামের একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আমি গিয়ে দেখি হাবিবের দেহ ঝুলে আছে। ফোনে বিষয়টি বায়েজিদ থানার ওসিকে জানালে উনি এসে লাশ চমেক হাসপাতালের মর্গে পাঠান। মর্গে পাঠানোর আগে হাবিবের বাম হাঁটুর নিচে রক্ত গড়াচ্ছিল। প্যান্টের কাপড় উঠিয়ে দেখি বিশাল একটা আঘাতের তাজা চিহ্ন।’
বায়েজিদ থানার ওসি আতাউর রহমান খন্দকার জানান, ‘বৃহস্পতিবার বিকেলে চমেক হাসপাতালের মর্গে হাবিবুর রহমানের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে তার মা বাবার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সচেষ্ট আছি।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হাবিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ওই মাদ্রাসায় তালা লাগিয়ে দেয়। এলাকাবাসীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়েছেন সাতকানিয়া থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা নদভী। এ ব্যাপারে জানতে সাংসদ নদভীকে রাত ৮.৪২টায় ফোন করা হলে তার মুঠোফোনটি ব্যস্ত পাওয়া যায়।
ইসমামের মৃত্যু এখনও এক রহস্য
বাঁশখালীর বৈলগাঁও এলাকার মরহুম নাজিম উদ্দিনের চার সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ ইসমাম হায়দার । মা জয়নাব আকতারের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ‘আলেমে দ্বীন’ হিসেবে গড়বেন। তাই ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ইসমামকে ভর্তি করালেন নগরের সেগুনবাগান তালীমুল কুরআন মাদ্রাসার হেফজ বিভাগে। মাত্র তিন মাসের মাথায় পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ হলো। ৭ মার্চ লাশ হয়ে ফিরলেন ঘরে। দুই বছর পার হলেও এখনো রহস্যই রয়ে গেল ইসমামের মৃত্যুর ঘটনা।
ইসমামের পরিবার জানায়, সেদিন সন্ধ্যায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ইসমামের পরিবারকে ফোনে জানায় সন্ধ্যা থেকে ইসমামকে পাওয়া যাচ্ছে না। খবর পেয়ে ইসমামের স্বজনরা মাদ্রাসায় প্রবেশ করতে চাইলে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বাধা দেয়। তখন স্থানীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ইসমামের স্বজনরা ফটক ভেঙে মাদ্রাসার ভেতরে প্রবেশ করে তার লাশ উদ্ধার করে বিছানার নিচ থেকে।
ইসমামকে হত্যার অভিযোগ এনে তার বড় ভাই নাঈম উদ্দীন খুলশী থানায় হত্যামামলা দায়ের করেন। খুলশী থানা পুলিশ অভিযুক্ত শিক্ষক আবু তাহেরসহ দুজনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেন। আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠায়।
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ তৈয়্যবের কাছে ইসমামের মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আদালতের নির্দেশে মামলাটি এখন তদন্ত করছে সিআইডি। সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, মামলাটির তদন্ত চলমান। শীঘ্রই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
ইসমামের সহপাঠীদের বরাতে তার চাচাতো ভাই আতিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, শ্রেণিশিক্ষক আবু তাহের শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন করায় ইসমামের মৃত্যু হয়েছে।
আঘাতের চিহ্ন ছিল শাহরিয়ারের মুখ-বুক ও পেটে
নগরের জুবিলী রোডের ফোম মার্কেট গলির নুরুল আলমের পুত্র শাহরিয়ার আলম। পড়তো হালিশহর নতুন বাজার এলাকার নাহদাতুল উম্মাহ মাদ্রাসার হেফ্জ বিভাগে। ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় ওই মাদ্রাসার টয়লেট থেকে উদ্ধার করা হয় তার লাশ।
শাহরিয়ারের বড় বোন শামীমা বলেন, ১০ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ১১টায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মনির হোসেন তার মামা ইলিয়াছকে ফোনে জানান, ‘শাহরিয়ার টয়লেটে ঢুকে বের হচ্ছে না। আপনারা মাদ্রাসায় আসুন। আমরা মাদ্রাসা যাওয়ার পথে অধ্যক্ষ আবার জানালেন, ‘আপনারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চলে যান।’
অধ্যক্ষের কথামতো পরিবারের সদস্যরা চমেক হাসপাতালে যায়। পরিবারের সদস্যরা যাওয়ার পর হালিশহর থানা পুলিশ শাহরিয়ারকে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরিবারের সদস্যদের দাবি শাহরিয়ারের মুখ-বুক-পেটসহ বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। আমাদের ধারণা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে হালিশহর থানার ওসি (তদন্ত) বদরুল কবির চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, শাহরিয়ারের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা হয়েছিল। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আত্মহত্যা আসায় সেই মামলা আর কার্যকর হয়নি।