ঢাকার আওয়ামী লীগ যেভাবে দেখছে চট্টগ্রামের ভোট, ‘গায়েবি’ কৌশলই ভরসা

‘নির্বাচন ঘিরে চলছে পুলিশ কেনাবেচার কারবার’

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেকোনো নির্বাচন এলেই কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা থাকে তুঙ্গে। ২০১৪ সালের পরে ভোট মৌসুম এলেই ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সমালোচনায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। বিভিন্ন যুক্তিতর্কে এই সমালোচনা মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে যায় আওয়ামী লীগ। কোনো কোনো নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে নানামুখী তৎপরতা নিতেও দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলটিকে। কিন্তু বুধবার অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো চিন্তাই নেই আওয়ামী লীগের। নেই কোনো বিশেষ তৎপরতাও।

চসিক নির্বাচনে এটা আওয়ামী লীগের নয়া কৌশল বলে দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন। চট্টগ্রামের স্থানীয় নেতারাও স্বীকার করেছেন এই কৌশলের কথা। চট্টগ্রামে সাংগঠনিক দুর্বল অবস্থা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকায় নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়টিকে ঝুঁকি হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীনরা।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চট্টগ্রামে আমাদের সাংগঠনিক রাজনীতি ভীষণ নড়বড়ে। তার ওপর রয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে চসিক নির্বাচনে কোনো রিস্কে যেতে চায় না আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।’

চট্টগ্রামের মেয়র পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানে সিকিভাগ ঝুঁকি নেওয়াও যাবে না উল্লেখ করে সম্পাদকমণ্ডলীর এই নেতা আরও বলেন, ‘তবে চসিক নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করতে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ভোটের শেষ দিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মানুষের ভেতরে সেই আমেজ-উৎসব বিরাজমান। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও প্যারোডি গানে প্রচারণায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে চসিক নির্বাচন বেশ জমে উঠছে।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, ‘আমার জানামতে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আমাদের মেয়র প্রার্থীর অবস্থা অনেক ভালো। তবে স্থানীয় রাজনীতিতে কিছুটা দলাদলি রয়েছে। ফলে সাংগঠনিক অবস্থা অগোছালো হতে পারে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত।’

এদিকে চট্টগ্রামের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় কোনো নেতাকর্মীর ভেতরেই সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতি নেই। দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থান এবং দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির কারণে সুষ্ঠু নির্বাচনের চিন্তা মাথায় আনতে পারছেন না ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। তারা মনে করছেন, ‘গায়েবি’ ভোটেই জিতবেন, জিততে হবে আওয়ামী লীগকে। প্রচার-প্রচারণায় সর্বাধিক তৎপরতা দেখালেও চট্টগ্রামের নেতাদের আশা, ভোট হবে ‘গায়েবি’।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘চট্টগ্রামে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থাও একেবারেই নাজুক। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও হয়তো আওয়ামী লীগই জিতবে। তবে সেটা ঝুঁকি হয়ে যায় বলে বিকল্প কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।’

চট্টগ্রামে বাড়ি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এমন এক নেতা বলেন, ‘গায়েবি ভোটের আশায় চসিক নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম নিজেই নির্ভার রয়েছেন। প্রার্থী হিসেবে তার যতটা শ্রম দেওয়া উচিত, সেটা তিনি নিজেও করছেন না। প্রার্থী রেজাউল মনে করেন তাকে মনোনয়ন দিয়েছে দল, বিজয়ীও করবে দল। ফলে চসিকের মেয়র প্রার্থী নির্ভার।’

চট্টগ্রামে বাড়ি ছাত্রলীগের প্রভাবশালী সাবেক এক নেতা বলেন, ‘নির্বাচনে উৎসব-আমেজ সবই রয়েছে। এখানে ভূরিভূরি কেন্দ্রীয় নেতা সফর করে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে রাজনীতি অনুপস্থিত।’

সেটা কী রকম তা জানতে চাইলে সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘এখানে দলীয় রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তিগত দলাদলির রাজনীতি চলে। এ কারণে সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল গত ৫ বছর যাবৎ। দলাদলির কারণে মেয়র প্রার্থীর চেয়ে অনেক প্রভাবশালী নেতা নিজের পকেটে পুরা কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও বিজয়ী করতে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। এ কারণে কাউন্সিলর ভোট নিয়ে সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফিরিঙ্গিবাজারসহ অন্তত ১৫টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। অন্তরালে রয়েছেন স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতা। এই বিরোধ নিষ্পত্তি করতে কেন্দ্র থেকে বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৫ জন কাউন্সিলর প্রার্থীকে কোনোভাবেই বসানো সম্ভব হয়নি।’

ছাত্রলীগের সাবেক ওই নেতা আরও বলেন, ‘চসিক নির্বাচনকে ঘিরে বন্দর নগরীতে এখন চলছে দায়িত্বশীল পুলিশদের কেনাবেচার কারবার। কে কত দামে, কিনতে পারে শেষ সময়ে সে চেষ্টা চলছে। এই কেনাবেচায় পিছিয়ে নেই বিএনপির প্রার্থীরাও। পুলিশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে তাদের বাসা, দামি রেস্টুরেন্ট এগুলোকে বেছে নেওয়া হচ্ছে।’

চসিক নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেয় শুধুমাত্র মেয়র প্রার্থীকে। কাউন্সিলর প্রার্থীকে সমর্থন দেয়। তবে আমাদের সমর্থনের বাইরেও কিছু কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচন করছেন। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি তাদের বসিয়ে দেওয়ার। কিন্তু কাউন্সিলর প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচনে কোনো ফ্যাক্টর হবেন না।’

উৎস: দেশ রূপান্তর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!