রাতে তিন কন্যার বিয়েতে চট্টগ্রামে জমকালো আয়োজন, বরের হাতে কন্যাদানে ডিসি স্বয়ং

চট্টগ্রামের ঐতিহ্য অনুসারে টাকার বিনিময়ে ধরা হল গেট। টাকা নিয়ে দরকষাকষিও হল রীতিমতো। প্রায় এক হাজার মানুষের খাবারের আয়োজন নিয়ে এলাহী কারবার। এর আগে থেকেই প্রত্যেক কন্যার জন্য তৈরি ছিল সংসার সাজানোর নানান জিনিস— ফ্রিজ, খাট থেকে ড্রেসিং টেবিলও। মঞ্চে বসা তিন কন্যার গায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া স্বর্ণ অলংকার। সবমিলিয়ে রীতিমতো রাজকীয় আয়োজন।

বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) রাত নয়টায় চট্টগ্রামের অফিসার্স ক্লাবে এভাবেই অনুষ্ঠিত হল সরকারি শিশু পরিবারে (বালিকা) বেড়ে ওঠা তিন কন্যার শুভবিবাহ। বিয়ের পুরো আয়োজনটিই হয়েছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে।

রাতে তিন কন্যার বিয়েতে চট্টগ্রামে জমকালো আয়োজন, বরের হাতে কন্যাদানে ডিসি স্বয়ং 1

এই তিন কন্যা হলেন মর্জিনা আক্তার, মুক্তা আক্তার ও তানিয়া আক্তার। তার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন যথাক্রমে মো. ওমর ফারুক, মো. নুরউদ্দিন ও হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে। প্রত্যেকেরই দেনমোহর হিসেবে ধরা হয়েছে সাত লাখ টাকা করে।

রাতে তিন কন্যার বিয়েতে চট্টগ্রামে জমকালো আয়োজন, বরের হাতে কন্যাদানে ডিসি স্বয়ং 2

বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের উপস্থিতিতে কন্যাদান করা হয়।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিয়ের এমন হুলস্থূল কারবার দেখে শুরুতে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, জেলা প্রশাসকের পরিবারের কারও বিয়ে হচ্ছে। তবে না, বিয়ে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা ওরকম কিছু নয়। রীতিমত ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল চট্টগ্রাম শিশু পরিবারের তিন অনাথ মেয়ের। আর দশটা সাধারণ বাবার মতই সব দায়িত্ব নিয়েই এই তিন কন্যাকে পাত্রের হাতে তুলে দেওয়া হল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

নিজেদের তিন কন্যার মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। প্রধানমন্ত্রী দাওয়াত গ্রহণ করে তিন কন্যার জন্য তিন সেট স্বর্নালংকার উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন বলে জানান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।

তিন কন্যার বিয়েতে কোনো ধরনের কার্পণ্য করেনি জেলা প্রশাসন। এর আগে করা হয়েছে আকদ্, গায়ে হলুদও। এমন জমকালো বিয়েতে দাওয়াত পেয়েছেন চট্টগ্রামের সকল মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, মেয়র ও সংসদ সদস্যরাও। এছাড়াও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ গণমান্য ব্যক্তিবর্গ।

তিন বরের প্রত্যেকের পক্ষ থেকে ১০০ বরযাত্রী আসবেন— সেটাই আগেই পাকা কথা ছিল। অন্যদিকে মেয়ের পরিবারের পক্ষে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তর, শিশু পরিবারের কর্তাব্যক্তিরাসহ হাজারজনের আয়োজন ছিল এই বিয়েতে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওরা জন্মের পরই পরিচয়হীনভাবে বেড়ে উঠেছে। তবে আমরা চাই না তারা পরিচয়হীনভাবে বাকি জীবনটুকু কাটাক। তাই আমরা তাদের পিতার দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের মেয়ের বিয়ের মত করেই জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিয়ের আয়োজন করেছি। সাধারণ দশটা বিয়েতে যেসব আনুষ্ঠানিকতা মানা হয় আমরা তার সবগুলোই মানার চেষ্টা করেছি। আমরা আমাদের মেয়েদের অলংকার থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর আসবাবপত্রও দিচ্ছি। তাদের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিশ্চয়তার জন্য ফিক্সড ডিপোজিটও করে দিয়েছি।’

এত আয়োজন কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘তাদের পরিবার নেই, বাবা নেই। তাই তারা যেন কখনও এই অভাবটা বোধ না করতে পারে সেজন্যই আমাদের এত আয়োজন। আমার মেয়ের বিয়েতে আমি যে দায়িত্ব পালন করতাম, ঠিক এই তিন মেয়ের বিয়েতেও আমি সেইম দায়িত্ব পালন করছি। ওরা আমাদেরই মেয়ে। আমাদের পরিচয়েই তারা বাকি জীবন কাটাবে।’

তিন কন্যার মধ্যে দুজন আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী এবং অন্যজন একই কলেজের ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত। এছাড়াও তাদের প্রত্যেকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে কর্মরত আছেন। অপরদিকে বরদের মধ্যে দুজন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে কর্মরত। বরদের অপর একজন চট্টগ্রামের ফলের আড়ৎ ফলমন্ডির একটি দোকানে ফল বিক্রেতা হিসেবে কাজ করেন।

জানা গেছে, তিন কন্যাই নিজেরা নিজেদের বর পছন্দ করেছেন। পরে তাদের পছন্দের কথা জানানো হয় শিশু পরিবারের কর্তাদের। এরপর তাদের পছন্দের পাত্রদের খোঁজখবর নিয়ে এবং একাধিকবার পাত্রপক্ষের পরিবারের সাথে বসে কথা বলে বিয়ের দিন ঠিক করে জেলা প্রশাসন।

চট্টগ্রামের রৌফাবাদ এলাকায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালনাধীন এই শিশু পরিবারে বর্তমানে ১০০ অনাথ শিশুর ভরণপোষণের কাজ চলছে। নিজেদের হাতে বড় হওয়া মেয়েদের বিয়ে উপলক্ষে ভীষণ খুশি প্রতিষ্ঠানটির উপ-তত্ত্বাবধায়ক মোছাম্মৎ তাসনিম আক্তার। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আজ যে তিনজনের বিয়ে হচ্ছে তাদের একজন ১ বছর, অন্যরা ২ ও ৪ বছরে আমাদের পরিবারে আসে। এরপর থেকে আমরা তাদের নিজেদের মেয়েদের মত করে লালন পালন করেছি, শিক্ষিত করেছি এবং পাশাপাশি নৈতিক ও চারিত্রিক শিক্ষা দিয়েছি।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে চট্টগ্রামে তিনটি ‘শিশু পরিবার’ পরিচালিত হয়ে আসছে। এদের মধ্যে নগরীর রৌফাবাদে অবস্থিত ১০০ জনের বালিকা শিশু পরিবার ছাড়া বাকি দুটিই ছেলেদের জন্য। এগুলোর একটি রয়েছে হাটহাজারীতে ও অপরটি পটিয়া উপজেলার হুলাইন এলাকায়।

এই শিশু পরিবারে প্রত্যক অনাথ শিশুরা ১৮ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া ও পড়ালেখার সুবিধা পেয়ে থাকে। ১৮ বছরের পর সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহযোগিতা বা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নিজেরা নিজেদের কর্মস্থান ঠিক করে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!